Categories
Report

বিহারে ‘ঢাই আখর প্রেম’ সাংস্কৃতিক পদযাত্রা মানুষকে ভালবাসার বার্তা দিল

Read in: हिन्दी | English | বাংলা | ಕನ್ನಡ | മലയാളം

‘ঢাই আখর প্রেম’ জাতীয় সাংস্কৃতিক পদযাত্রা দেশের রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত প্রদেশে প্রেম, বন্ধুত্ব, সাম্য, ন্যায় আর মানবতার বার্তা নিয়ে যাত্রা। এই যাত্রা ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৩ থেকে ৩০ জানুয়ারি পর্যন্ত প্রায় ২২টি রাজ্যে জনসংযোগ স্থাপন করছে। সর্বভারতীয় এই জাঠার প্রথম পর্ব ২৮ সেপ্টেম্বর ভগৎ সিং-এর জন্মদিনে আলোয়ার (রাজস্থান) থেকে শুরু হয়ে ২ অক্টোবর মহাত্মা গান্ধীর জন্মদিনে আলোয়ারে সমাপ্ত হবে। তারই অংশ হিসেবে ৩ থেকে ৬ অক্টোবর ছত্তিশগড়, মধ্যপ্রদেশ, ঝাড়খণ্ড আর উত্তর প্রদেশে এক একদিনের পদযাত্রার পর তৃতীয় পর্যায়ে বিহারে ৮ অক্টোবর পাটনা থেকে শুরু হয়।   

০৭ অক্টোবর, ২০২৩, শনিবার

বিহারে ঢাই আখর প্রেম সর্বভারতীয় পদযাত্রার শুরুতে গান্ধী ময়দানে নাগরিকদের সামনে ইপ্টার সর্বভারতীয় কার্যনির্বাহী সভাপতি রাকেশ বলেন, এই পদযাত্রায় আমরা বাপু, কবীর, রহিম, রসখানের পদচিহ্ন আর চিহ্ন ধরে যাত্রা করছি। এই যাত্রায় বাপুর চম্পারণ সত্যাগ্রহের পদচিহ্ন ধরে চলার চেষ্টা হবে, কারণ দেশের গান্ধী আর চম্পারণ দুই-ই জরুরি। ভয়ের বাতাবরণ তৈরি করে জবরদস্তি চাপানো বক্তব্য মানতে বাধ্য করার বিরুদ্ধে প্রেম আর বন্ধুত্বের অভিযানে সেই গান্ধীজিকে খোঁজা হবে, যিনি নীলচাষের তেকাঠির পরম্পরাকে ভেঙে দিয়েছিলেন। সেই সাম্রাজ্যকে নত হতে বাধ্য করেছিলেন, যার সাম্রাজ্যে সূর্য কখনও অস্ত যেতো না।

ঢাই আখর প্রেম পদযাত্রা শুরু হয় বাঁকিপুর (পাটনা জংশন) স্টেশন থেকে। ১৯১৭ সালের এপ্রিল মাসে বাপু প্রথম বার বিহারে আসেন আর মজফফরপুর হয়ে চম্পারণ যান। চম্পারণেই তিনিই স্বাধীনতা আন্দোলনের পথ খুলে দিয়েছিলেন। পাটনা জংশন থেকে শুরু এই পদযাত্রা পাটনা ইয়ুথ হোস্টেল হয়ে ভগৎ সিং ও মহাত্মা গান্ধীর মূর্তিতে মালা দিয়ে ভিখারী ঠাকুর রঙ্গভূমি পৌঁছায়। সেখানে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়। পদযাত্রায় অংশগ্রহণকারীরা ‘তু খুদ কো বদল, তব তো জমানা বদলেগা’ গান গাইতে গাইতে পথ চলেন। ঢাই আখর প্রেম-এর স্লোগান উঠতে থাকে।

সাংস্কৃতিক যাত্রায় প্রখ্যাত চিকিৎসক ডা. সত্যজিত, প্রগতিশীল লেখক সঙ্ঘের সুনীল সিং, লোক পরিষদের রূপেশ আর বিহার রাজ্য ইপ্টার সাধারণ সম্পাদক ফিরোজ আশরাফ খান বক্তব্য বলেন। ছত্তিশগড় থেকে আসা লোকনাট্য মণ্ডলী নাচা-গম্মত শৈলীর নাটক অভিনয় করেন। যুব পদযাত্রীরা কবীরের ভাবনার ভিত্তিতে একটি ভাবনৃত্য উপহার দেন।

প্রেম, বন্ধুত্ব, সাম্য, ন্যায় আর মানবতার বার্তা নিয়ে ঢাই আখর প্রেম পদযাত্রা পরবর্তী গন্তব্য জসৌলি পট্টি পৌঁছায়। এই পদযাত্রা আগামী সাত দিনে অনেক গ্রামের মানুষের সঙ্গে কথা বলতে বলতে ১৪ অক্টোবর ২০২৩ মোতিহারির গান্ধী স্মারক চত্বরে একটি জনসভার মাধ্যমে সমাপ্ত হবে। ঢাই আখর প্রেম সাংস্কৃতিক পদযাত্রায় বিহারের নাট্যকর্মী, লেখক, কবি, অভিনেতা, গায়ক আর সমাজকর্মীরা অংশ নিয়েছেন। পদযাত্রায় নাটক, গান, নাচ, লোককথায় আলোচনা আর নাগরিকদের সঙ্গে সরাসরি বার্তালাপ করা হয়।


০৮ অক্টোবর, ২০২৩, রবিবার

৮ অক্টোবর মুজফফরপুরে লোকনায়ক জয়প্রকাশ নারায়ণ পার্ক হয়ে ছাতা চকে এসে সেখানে পুষ্পাঞ্জলি দিয়ে নাট্যকর্মীরা গানের আয়োজন করেন। এর পর জাঠা পায়ে হেঁটে লঙ্গট সিং কলেজ পৌঁছায়। সেখানে গান্ধী স্মারক কূপে গিয়ে পুষ্পার্ঘ্য দেওয়া হয়। চম্পারণের যাত্রাপথে গান্ধীজি এখানে থেকেছিলেন। এই কুঁয়োর জলেই গান্ধীজি স্নানাদি সেরেছিলেন।

প্রেম, বন্ধুত্ব, ন্যায়, সাম্য আর মানবতার বার্তা দিতে দিতে, স্থানীয় লোকেদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে, তাদের থেকে শিক্ষা নিয়ে গান গাইতে গাইতে এগোতে থাকে। জাঠার সাথীরা একটি গানে যাত্রার উদ্দেশ্য বলছিলেন – ‘হাম ঢাই আখর প্রেম পড়নে আউর পড়ানে আয়ে হ্যায়/ হাম ভারত সে নফরত কা হর দাগ মিটানে আয়ে হ্যায়’। বিহারের জাঠায় যোগদানকারী সাথীরা গান্ধী, কবীর, রুইদাস, আম্বেদকর, ভগত সিং এবং সুফি আর সন্ত কবিদের প্রেমের ঐতিহ্যকে মানুষের মধ্যে পৌঁছচ্ছিলেন। নানা জায়গায় প্রেমের প্রকাশ হিসেবে লোকেদের গামছা দিয়ে সম্মান জানানো হচ্ছিল। কবীরের তাঁতে তৈরি চাদর আর গামছা আমাদের শ্রমজীবীর পরিচয়। তাকেই একেক জনের কাছে পৌঁছানো এই জাঠার অন্যতম উদ্দেশ্য।

জাঠা মজফফরপুর থেকে রওনা হয়ে মুসহরি ব্লকের জামালাবাদ আশ্রম পৌঁছায়, যেখানে ‘জয়প্রকাশ প্রভাবতী মুশহরি স্বর্ণজয়ন্তী সম্বাদ’ পদযাত্রার সমাপ্তি অনুষ্ঠান হচ্ছিল। সেখানে জাঠার সাথীরা পরস্পরের সঙ্গে আলোচনায় নিজেদের উদ্দেশ্য ব্যক্ত করেন। ইপ্টার সর্বভারতীয় কার্যনির্বাহী সভাপতি রাকেশ তার বক্তব্যে বলেন, ‘এই জাঠা জামালাবাদে জয়প্রকাশ জির সমাপ্তিতে একত্রিত হয়ে এক ঐতিহাসিক আবহ তৈরি করেছে। এক যাত্রার সমাপ্তিতে আরেক যাত্রার শুরু এমন এক বিন্দু, যা আমাদের শেখায় যে, আমাদের নিজেদের পরম্পরা, সংস্কৃতির শৃঙ্খলা এমনভাবে জুড়ে আছে যে, তা কেবল সামাজিক সংস্কৃতিকে বাঁচিয়েই রাখে না, তাঁকে শক্তিশালী করে। এটি অবিরাম জারি থাকা প্রেমের ধারা, যা কখনও শুকোয় না, আর আমরাও তাঁকে শুকোতে দেব না। কারণ, এটি শুকিয়ে গেলে যে কোনও দেশের জন্য তা হবে আত্মহত্যার সামিল। আমাদের সংকল্প হল, গ্রামের মজুর, কিষাণ, মহিলাদের সংগ্রামের সঙ্গে তাদের গানকে জুড়ে সাম্য, সমতা আর ভ্রাতৃত্বের উপর নির্ভরশীল একটি সমাজের নির্মাণ। আমরা মানুষের থেকে শিখতে শিখতে এই যাত্রাকে এগিয়ে নিয়ে যাব।’

ঢাই আখর প্রেমের বার্তা নিয়ে সাংস্কৃতিক পদযাত্রা চম্পারণ পৌঁছায়। ৮ অক্টোবর ২০২৩ রাত্রে জাঠা জসৌলি পট্টি গ্রামের এক প্রান্ত থেকে শুরু হয়ে রাষ্ট্রীয় মধ্য বিদ্যালয়, জসৌলি পট্টি ব্লক কোটবা, পূর্ব চম্পারণ পৌছায়, যেখানে লোকেরা রাত্রিবাস করেন। তার আগে গ্রামে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয় বিরাট এক মাঠে। গ্রামে পৌঁছাতেই গ্রামবাসীরা তাদের স্বাগত জানান। মানুষ ঘরের বাইরে এসে জাঠাকে স্বাগত জানাচ্ছিলেন। প্রত্যেক মোড়ে মোড়ে গান ইত্যাদির সঙ্গে যাত্রার গুরুত্বকে মানুষ অভিনন্দন জানান।

গ্রামের বাসিন্দা বিনয় কুমার, যিনি পরিবেশ নিয়ে কাজ করেন, জাঠার সবাইকে শুধু স্বাগতই জানাননি, রাতে স্কুলের মাঠে যে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হবে, সেখানে বেশি সংখ্যায় যোগদানের জন্য লোকেদের বলেন। সবথেকে বেশি উপস্থিতি ছিল মহিলা ও শিশুদের। আড়াই ঘণ্টা ধরে চলে সঙ্গীত, নাটক, বক্তব্যের অনুষ্ঠান। সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ, নিজেদের উতসাহে মঞ্চের অনুষ্ঠানে জাঠার সাংস্কৃতিক কর্মীদের সঙ্গে বাচ্চাদেরও অংশগ্রহণ। মঞ্চ থেকে সবাইকে স্বাগত জানিয়ে বিনয় কুমার এই গ্রামের ঐতিহাসিক গুরুত্ব ব্যাখ্যা করেন। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে রামশ্রেষ্ঠ বৈদা, সুনীল দাস, দিলীপ ঠাকুর, উপেন্দ্র কুমার, মঙ্কেশ্বর পাণ্ডে, প্যাকস এর সভাপতি জুলুম যাদব, রামজী রায়, হরেন্দ্র কুমার, জিতেন্দ্র কুমার প্রমুখ অংশ নেন।

সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান শুরু হয় লক্ষ্মীপ্রসাদ যাদবের গানে। তার ‘বড়ে চলো জওয়ান, তুম বড়ে চলো’ সবার প্রশংসা পায়। তাঁর পরের গান ছিল চন্দ্রশেখর ভরদ্বাজের লেখা ‘ক্যাসে জৈবেঙ্গে সজনিয়া পাহাড় তোড় লো, হামারা অঙ্গুলি সে খুনবা কি ধার বহে লো’। হারমোনিয়ামে সঙ্গত করছিলেন অমরনাথ। শিবানী গুপ্ত গ্রামের বাচ্চাদের নিয়ে ‘হাম সব ইসকে মালিক, হিন্দুস্থান হামারা হ্যায়’ গেয়ে শোনান। তাঁর দ্বিতীয় গান ছিল ‘রৈলিয়া বৈরন পিয়া কো লিয়ে যায়ে রে, রৈলিয়া বৈরন’। ‘ক্যাসে খেলে জাইবু সাওন কে কজরিয়া, বদরিয়া ঘিরি আইল ননদী’ গেয়ে সবাইকে মন্ত্রমুগ্ধ করে দেন।

এর পর সর্বভারতীয় কার্যনির্বাহী সভাপতি রাকেশ নাগরিকদের উদ্দেশ্যে তার ভাষণে জাঠার উদ্দেশ্য ব্যাক্ত করে বলেন, বিশ্বের মানচিত্রে যে সব বিপ্লবী গ্রাম আছে, তার মধ্যে জসৌলি পট্টি অন্যতম। এক পর্বে তিনি গান্ধীজির সঙ্গে চার্লি চ্যাপলিনের আলাপের প্রসঙ্গ উত্থাপন করে বলেন, ‘গান্ধীজি চ্যাপলিনকে জিজ্ঞাসা করেছেন, এইসব শিল্পকলার উদ্দেশ্য কি? গানবাজনারই বা উদ্দেশ্য কি? চ্যাপলিন বলেছিলেন, গান, কবিতা ইত্যাদির আসল উদ্দেশ্য হল মানুষের প্রতি প্রেমপত্র। একই সঙ্গে সেটা ক্ষমতার প্রতি অভিযোগ পত্রও বটে’।

তার পরে হিমাংশু আর অন্যান্য সাথীরা গান ধরেন ‘গঙ্গা কি কসম, যমুনা কি কসম, ইয়ে তানা-বানা বদলেগা, তু খুদ কো বদল, জমানা বদলেগা’। এর পরে জাঠার যাত্রী মনোজ ভাই বাচ্চাদের হাত সাফাইয়ের জাদু দেখিয়ে মানুষকে বলেন, জাদু আসলে কিছুই না, হাত সাফাইয়ের খেলা। এর পরের অনুষ্ঠান ছিল নৃত্যের মাধ্যমে কবীরের দোঁহার প্রচার। একদম শেষে ছিল ছত্তিশগড়ের নিসার আলী ও তার সঙ্গীদের নাটক ‘টর্চ বেচৈয়া’। এটি ছত্তিশগড়ের নাচা-গম্মত শৈলীর প্রদর্শন। একদম নতুনত্বের কারণে এটি গ্রামবাসীদের খুব ভালো লেগেছে।

০৯ অক্টোবর, ২০২৩, সোমবার

৯ অক্টোবর সকালে জাঠা জসৈলি পট্টি মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে বেরিয়ে গোটা গ্রাম প্রদক্ষিণ করে। ৯ থেকে ১০ কিলোমিটার জুড়ে জসৌলি খুব বড় গ্রাম, যার জনসংখ্যা ১০,০০০ এর মতো। এখানকার ১২টি ওয়ার্ডে সব জাতির মানুষেরই বাস। একটি মুসলিম পরিবারও আছে। গ্রামের সব মানুষই সহযোগিতার মানসিকতা নিয়ে আছেন। কোনও জাতিগত বা ধর্মীয় অশান্তি নেই। মূল অর্থনৈতিক ভিত্তি কৃষি, কিছু মানুষ বাইরে থেকে চাকরি করেন। জাঠা নিয়ে মানুষের মধ্যে দারুণ উৎসাহ। চারপাশে ক্ষেতে ধান, ভুট্টা, আখ লাগানো হয়েছে। এখানে বিপুল পরিমাণে সবজি চাষও হয়।

জাঠা সকালে স্কুল থেকে বেরনোর সময় নিসার আলী তার সাথীদের নিয়ে ‘মশাল লেকর চলনা হ্যায় কি যব তক রাত বাকি হ্যায়’ গাইতে শুরু করলেন। গ্রামের বাচ্চারাও তার সঙ্গে গলা মেলাচ্ছিল। সর্বভারতীয় কার্যনির্বাহী সম্পাদক রাকেশ সাথীদের নিয়ে তার সঙ্গে চলছিলেন। কিছু দূরে দূরে থেমে থেমে গ্রামবাসীদের সাথে কথা বলে, তাদের থেকে শুনে, নিজেদের কথা বলে জাঠা এগোচ্ছিল। শুধু নিজেদের কথা বলাই নয়, তাদের থেকে শোনাও। এর খুব প্রভাব পড়েছে। গ্রাম অনেক বড় বলে ঘরবাড়িও দূরে দূরে। ক্ষেতের আল বেয়ে, সড়কে উঠে জাঠা এগিয়ে যায়।

একটি লোহার সেতু পেরিয়ে জসৈলি পট্টির অপরাংশ পট্টি গ্রামে জাঠা পৌঁছায়। এখানে বিষুণপুর ননকার গ্রামের মানুষদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে ৩ কিলোমিটার গিয়ে কোটবা ব্লকের মহাত্মা গান্ধী মধ্য বিদ্যালয়ে পৌঁছায়। স্কুলে ছাত্রদের সঙ্গে শিক্ষকরা তাদের প্রধান শিক্ষকের নেতৃত্বে আমাদের স্বাগত জানাতে উপস্থিত ছিলেন। স্কুল প্রাঙ্গনে গান্ধীজির মূর্তিতে সকলে পুষ্পার্ঘ্য দেন। প্রধান শিক্ষক অশোক সিং, শিক্ষক জিতেন্দ্র কুমার, বিপিন বিহারী প্রসাদ প্রমুখ জাঠার সাথীদের সঙ্গে গুলমোহর আর অমলতাস গাছের চারা লাগান। পড়ুয়াদের যাত্রার উদ্দেশ্য বলা হয়। স্কুলের কাছে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়।

এখান থেকে গিয়ে স্থানীয় ধ্রুবনারায়ণের ঘরে প্রাতঃরাশের পর সেখানে লোমরাজ সিং-এর মূর্তিতে মাল্যার্পণ করা হয়। তার বাড়িতে গিয়ে পরিবারের সঙ্গে দেখা করে প্রেম আর শ্রমের প্রতীক গামছা আর কাঁধের ঝোলা ব্যাগ উপহার দেওয়া হয়। এই সম্মান প্রদর্শনে ভাববিহ্বল ৮৫ বছরের প্রবীণ রঘুনাথ সিং বলেন, ‘আপনারা সবাই যা করলেন, তাতে এখানকার কৃষকদের অতীতের নানা সংগ্রামই সম্মানিত হল। এই গ্রামকে আপনারা যে সম্মান দিয়েছেন, তার জন্য আমি কৃতজ্ঞ’। তার চোখ ছলছল করছিল।

এখান থেকে সিরিসিয়া গ্রামে গেলে সেখানকার প্রধান জিতেন্দ্র প্রসাদ যাদব গ্রামবাসীদের নিয়ে জাঠাকে স্বাগত জানান। এই গ্রামে জাঠা পৌঁছায় বেলা ১২টা নাগাদ, আর সাড়ে বারোটায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান শুরু হয়। গ্রামের চকে বিপুল সংখ্যায় মানুষ এসেছিলেন। অনুষ্ঠানের শুরু হয় লক্ষ্মীপ্রসাদ যাদবের গান ‘জওয়ান তুম বড়ে চলো’ দিয়ে। এর পর রাজেন্দ্র জি ‘লেহলি দেশবা কে আজদিয়া বাপু খাদিয়া পহন কে ন…’ এবং তার পর ‘তোহর হিরা হেরা গইল কচড়ে মে…’ এবং কবীরের গান শোনান, যা প্রশংসিত হয়।

মোতিহারির ব্যাখ্যাকার হরিশচন্দ্র চৌধরী বক্তব্য বলেন। ইনি চম্পারণ আন্দোলন নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ বই লিখেছেন। খাওয়ার পর রাস্তায় জনসম্পর্ক করতে করতে জাঠা কোটবা বাজার পৌঁছায়। স্থানীয় লোকেদের সঙ্গে কথাবার্তার পর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়। গান শোনান হিমাংশু কুমার, সঞ্জয়, শিবানী গুপ্তা, তন্নু কুমারী, অভিষেক কুমার, মায়া কুমারী, পূজা কুমারী, সুবোধ কুমার, রাহুল কুমার প্রমুখ। এখান থেকে বেরিয়ে জাঠা রাত ৮টায় ঝখরা বলুয়া গ্রামে পৌঁছায়। সেখানে স্থানীয় নাগরিক যোগী মাঝি ও অন্যান্যরা জাঠাকে স্বাগত জানান। কবীর গামছা দিয়ে যোগী মাঝিকে সম্মান জানানো হয়। সাড়ে আটটায় গ্রামবাসীদের সঙ্গে আলাপের পর গানের অনুষ্ঠান শুরু হয়, যাতে রাজেন্দ্রপ্রসাদ রায়, লক্ষ্মীপ্রসাদ যাদব ও অন্যরা অংশ নেন। এটি মজদুরদের গ্রাম, তা সত্বেও অনেক রাত পর্যন্ত তাদের উপস্থিতি খুবই উৎসাহব্যঞ্জক। গ্রামের মহিলা, শিশু ও যুবকরা তিন ঘণ্টার অনুষ্ঠান শোনেন। তারা জাঠার সম্পর্কে নানা প্রশ্নের উত্তর জেনে নেন। তারা প্রেম আর সাম্যের সমাজে নিজের বিশ্বাসের কথা জানান। রাত্রিবাস হয় এই গ্রামেই। 


১০ অক্টোবর, ২০২৩, মঙ্গলবার

ঝখরা বলুয়ার ঝখরা পট্টিতে ৯ অক্টোবর রাত্রিবাস হয়েছিল। সকাল সাড়ে ন’টায় ঝখরা বলুয়া থেকে জাঠা গ্রাম সফরে যায়। ‘গঙ্গা কি কসম, যমুনা কি কসম’ ইত্যাদি গান গাইতে গাইতে গ্রাম ঘুরে ১০টা ১৫-তে ঝখরা চকে জনসম্পর্ক করা হয়। এর পর রাষ্ট্রীয় উচ্চ মধ্য বিদ্যালয়ের সর্বশিক্ষা অভিযান ভবনে পড়ুয়াদের সঙ্গে আলোচনা হয়। এই স্কুলে প্রায় ৫০০ বিদ্যার্থী আছে। শিক্ষক সত্যেন্দ্র কুমার এবং প্রধান শিক্ষক চতুর্ভূজ বৈঠার সঙ্গেও আলোচনা হয়। তারা জানান, এখনও এখানে সার্বিক দারিদ্র্য। তার নিজেরই জমি নেই, বাথরুমও নেই। তাও মানুষ কষ্ট স্বীকার করেও এখানে শান্তিতে বাস করেন।

এর পর জাঠা যায় সূর্যপুর, একটি গরিবদের মোহল্লায়। সেখানেও লোকেদের সঙ্গে বার্তালাপ হয়। এর পর সূর্যপুর আম্বেদকর টোলায় গিয়ে সেখানকার লোকেদের সঙ্গে কথা হয়। বেলা ১১টা নাগাদ সূর্যপুর পিপরা কোঠি ব্লকের সরকারি মধ্য বিদ্যালয়ে গিয়ে শিক্ষক আর পড়ুয়াদের সঙ্গে কথাবার্তা হয়। জাঠার অংশগ্রহণকারীরা কিছু গান গেয়ে শোনান। প্রধান শিক্ষক, শিক্ষকগণ ও পড়ুয়াদের জাঠার উদ্দেশ্য বর্ণনা করা হয়। এই বিদ্যালয়ে ৫৫০ জন পড়ুয়া আছে, আর ১৩ জন শিক্ষক। প্রধান শিক্ষক প্রমোদ সিং। আলোচনায় বলা হয়, আমরা সাম্য আর সমতার ভিত্তিতে সমাজ বানাতে চাই। আমরা বাবাসাহেব আম্বেদকর, জ্যোতিবা ফুলে, গান্ধীজি, ভগত সিং প্রমুখ মহাপুরুষদের বিচারধারা নিয়ে গ্রামে গ্রামে যাচ্ছি। বাবাসাহেব বলেছিলেন, শিক্ষার জন্য সমাজের সংস্কার আবশ্যক। তাকেই এগিয়ে নিতে চাই। বৈষম্যের সংস্কৃতিকে বিদায় করতে চাই। সমতার সংস্কৃতি আনতে হবে। শিক্ষক বিনোদ রাম স্টিফন বলেন, ‘এই এলাকায় দলিত আর অতি পশ্চাদপদ জাতির লোকেদের বাস। একদা মুশহররা টোলে পড়তেন, শিক্ষার নামগন্ধও ছিল না। ঠিকমতো কথাও বলতে পারতেন না। এখানকার লোকেরাই সবাই মিলে শিক্ষার প্রসারে কাজ করেছেন। এখন একটু এগোতে পেরেছি’।

এর পর জাঠা পৌঁছায় জীবধরা। এই রাস্তায় গ্রাম আছে কমই, একেকটি গ্রাম তিন চার কিলোমিটার দূরে দূরে। দুপুরে জীবধরার প্রধান সড়কের পাশে জাঠার সাথীরা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করেন। ‘ঢাই আখর প্রেম কো হম জানতে হ্যায়/ বহুলতা মে একতা পহচানতে হ্যায়’ গানের পর গাওয়া হয় ‘গঙ্গা কি কসম, যমুনা কি কসম, ইহ তানা-বানা বদলেগা, তু খুদকো বদল, জমানা বদলেগা’।

এই যাত্রায় রাজ্যের বিভিন্ন জেলার তথা বিভিন্ন সংগঠনের সাথীরা যোগ দিয়েছেন। ঝাড়খণ্ডের প্রগতিশীল লেখক সঙ্ঘের সহসভাপতি পঙ্কজ শ্রীবাস্তব তার বক্তব্যে গান্ধীজির চম্পারণে আসার কাহিনি বলেন। এখানে অনুষ্ঠানের শেষ গান ‘তু জিন্দা হ্যায় তো জিন্দেগি কি জিত পে একীন কর,/ অগর কহি হ্যায় স্বর্গ তো উতার লা জমিন পর’ গেয়ে শোনান রীতেশ, হিমাংশু আর জাঠার অন্য সাথীরা। উপস্থিত সবাইকে রীতেশ ধন্যবাদ জ্ঞাপনের পর জীবধরা মলাই টোলার মুখিয়া পাশোয়ান জির ঘরে সবাই খাবার খান।

সেখান থেকে সাংস্কৃতিক জাঠা চন্দ্রদীপের উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে যায়। সেখানে গান্ধী স্মারকে গিয়ে স্থানীয় লোকেদের সঙ্গে কথাবার্তা হয়। এর পর সালেমপুর গিয়েও গ্রামবাসীদের জাঠার উদ্দেশ্য বলা হয়। সালেমপুরের মুকেশ জি বলেন, এমন জাঠা দেশের ঐক্য আর অখণ্ডতার জন্য এবং প্রেম ও বিশ্বাসের জন্য খুব প্রয়োজন। আমরা গ্রামবাসীরা আপনাদের জাঠাকে শুধু স্বাগতই জানাচ্ছি না, আপনাদের কাজের মুক্তকণ্ঠে প্রশংসা করছি। এখানে রাত্রিবাসের জন্য শঙ্কর সরাইয়ের দিব্যজোতি পাবলিক স্কুলে পৌঁছায়। এখানেই খাওয়ার ও থাকার ব্যবস্থা হয়েছিল। সাংস্কৃতিক কর্মসুচিতে শুরুতে লক্ষ্মীপ্রসাদ ‘বড়ে চলো, জওয়ান তুম বড়ে চলো’ গেয়ে শোনান। এর পর গাওয়া হয় ‘ক্যায়সে জৈবেঙ্গে সজনিয়া পাহাড় তোড় লো’ গান। গানটি উপস্থিত শ্রোতা দর্শকদের খুব পছন্দ হয়েছে। এর পর রাজেন্দ্র প্রসাদের গান ‘লিহলে দেশবা কে আজদিয়া খাদিয়া পহিনকে জি’। তার দ্বিতীয় গান ছিল ‘হামরা হিরা হেরা গইল কচরে মে’। এই গানের সম্পূর্ণ আনন্দ শ্রোতারা নিয়েছেন।

রঞ্জিত গিরি ও স্কুলের ম্যানেজার রামপুকার জি জাঠার সবাইকে প্রাণভরা ভালবাসায় স্বাগত জানান। রঞ্জিত গিরি একজন সমাজসেবী। তার যোগদান ও উপস্থিতি বিশেষভাবে উল্লেখ্য। সাংস্কৃতিক পদযাত্রার গুরুত্ব সম্পর্কে আলোকপাত করে রামপুকার জি বলেন, ‘আজ যে ভাবে বিশ্বে হিংসা বাড়ছে, তার জবাবে গ্রামে গ্রামে গিয়ে ভালবাসার কথা প্রচার ও প্রসার করে মানুষকে জাগানোর এই ভাবনা এবং মানুষের থেকে শিক্ষা নেওয়ার এই আকুতি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সমাজে ভ্রাতৃত্বের জন্য এমন কাজ খুব দরকার’।

এই কথা শুনে হিমাংশু কুমার ও সাথীরা ফের ‘গঙ্গা কি কসম, যমুনা কি কসম, ইহ তানা-বানা বদলেগা, তু খুদকো বদল, জমানা বদলেগা’ গান পরিবেশন করেন। পরের অনুষ্ঠান ছিল নিসার আলী ও তার সাথীদের ‘ঢাই আখর প্রেম’ নাটক। নিসার আলী আর তার সাথীরা ছত্তিশগড় থেকে এসে বিহারের এই জাঠার সঙ্গে লাগাতার সফর করছেন। তার নাচা-গম্মত শৈলীর নাটক ছোটদের খুব ভাল লেগেছে। এই নাটকে কবীর, রহিম, আদম গোণ্ডবীর রচনা বিশেষ ভাবে গ্রন্থিত হয়েছে। সেই সঙ্গে ভগত সিং, মহাত্মা গান্ধী, বাবাসাহেব আম্বেদকরের বক্তব্য থেকে প্রদত্ত উদাহরণগুলি খুবই শিক্ষামূলক। অনুষ্ঠানের শেষে হিমাংশু ও অন্য সাথীরা ‘তু জিন্দা হ্যায় তো জিন্দেগি কি জিত পে একীন কর’ গেয়ে শোনান। ধন্যবাদ জানান রীতেশ।


১১ অক্টোবর, ২০২৩, বুধবার

শঙ্কর সরাইতে রাত্রিবাসের পর সকাল ৬টায় জাঠা দিব্যজ্যোতি পাবলিক স্কুল থেকে পরবর্তী যাত্রা শুরু করে। গান গাইতে গাইতে চলা শুরু। হরদিয়া গ্রামের রঞ্জিত গিরি, গিরীন্দ্র মোহন ঠাকুর জাঠার পথপ্রদর্শক ছিলেন। প্রায় সাড়ে আটটা নাগাদ জাঠা টিকেইতি গ্রামে পৌঁছায়। অল্প সময় পরেই গোপালচক মাধোপুর গিয়ে জাঠার সাথীরা স্থানীয় লোকেদের সঙ্গে আলাপ করেন। রীতেশ বলেন, প্রত্যেক মানুষের কাছে ভালবাসার বার্তা পৌঁছে দিতে এই জাঠা গ্রামে গ্রামে ঘুরছে। বিদ্বেষ, ঘৃণায় বিষাক্ত সমাজে ভালবাসা ও সাম্য কীভাবে সম্ভব, সেটাই বলাই জাঠার উদ্দেশ্য।

তার পর সাথী নিসার আলী জাঠার বিষয়ে কিছু কথা বলে ‘রাহোঁ পর নীলাম হামারি ভুখ নেহি হো পায়েগি/ আপনি কৌশিশ হ্যায় কি অ্যায়সে সুবহ ইহা পর আয়েগি’ গান ধরেন। এই গান শুনতে ভিড়ে ছয়লাপ হয়ে যায় গোপালচক। ‘কভি না আপনা একা টুটে বটমারোঁ কি সাজিশ মে’ লাইনের সঙ্গে আপামর মানুষ গলা মেলান। রঞ্জিত গিরি তার বক্তব্যে বলেন, ‘এই চলমান জাঠার সঙ্গে যে সাথীরা জুড়ে আছেন, যে উদ্দেশ্য নিয়ে চলছেন, যে স্বপ্ন নিয়ে দেশের গ্রামে গ্রামে ঘুরছেন, তার সঙ্গে আমরা গ্রামবাসীরা সবাই যুক্ত হলে জাঠার শক্তি বাড়বে। আমরা ভালবাসায় থাকব, সংগঠিত হব, সাম্য আর সমতার ভিত্তিতে এক নতুন বিশ্বের জন্য সংগ্রাম করব’।

হিমাংশু তার তার সাথীরা, ‘গঙ্গা কি কসম, যমুনা কি কসম, ইয়ে তানা-বানা বদলেগা, তু খুদ কো বদল, জমানা বদলেগা’ ছাড়াও ‘হাম ঢাই আখর প্রেম পড়নে অউর পড়ানে আয়ে হ্যায়/ হাম ভারত সে নফরত কা হর দাগ মিটানে আয়ে হ্যায়’ গান গাওয়ার পর গ্রামবাসীরা উজাড় করে আর্থিক সহায়তা দেন। বিজয় শাহ, উবশ রাম, রঞ্জিত গিরি, গিরিন্দর ঠাকুর পুরো সময় জাঠার সঙ্গে চলছিলেন। এদের সহযোগিতা প্রশংসার যোগ্য।

গোপাল চকের দোকানপাট সকালে সাড়ে সাতটাতেই খুলে যায়। এই এলাকায় পুরোপুরি কিষাণ মজুরদের বাস। উপস্থিত লোকেদের বক্তব্য, এমন ধরণের কাজকর্মে আমরা একসঙ্গে বাঁচার মতো শক্তি পাই। শেষে উবশ রাম ধন্যবাদ জ্ঞাপন করে জাঠাকে পরের গন্তব্যের দিকে বিদায় জানান। প্রায় একঘণ্টা গোপাল চকে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও গ্রামীণদের সঙ্গে বার্তালাপ করে জাঠা এগিয়ে চলল। প্রায় সাড়ে আটটা নাগাদ জাঠা মাধোপুর মধুমালত পৌঁছায়। সেখানে দীনেশ মিশ্র আর সতবীর আহমদ সাহেব স্বাগত জানিয়ে বলেন, এই জাঠা ভ্রাতৃত্বকে মজবুত করবে। আমরা গ্রামবাসীরা সবাই জাঠাকে স্বাগত জানাচ্ছি। গ্রামের সমস্যাগুলি জানিয়ে তারা বলেন, এখানে রোজগারের কোনও নামগন্ধও নেই। চারপাশে বেকারত্ব। কোনও রকমে মানুষ বেঁচে আছেন। পরিস্থিতি খুব খারাপ। বেকার যুবকরা কোনও রকমে এখানে থেকে টুকটাক আয়ের পথ খুঁজছেন। তারা ক্ষেতে মজুরি, ছোট ছোট দোকানে কাজ করে জীবনধারণ করছেন। কিন্তু গর্বের বিষয় হল, এখানে কোনও রকমের জাতিগত বা ধর্মীয় অমানুষতা নেই। প্রত্যেকে অপরের পরব বা উৎসবে আসা যাওয়া করেন, একে অপরের সঙ্গে মেলামেশা করেন। এখন দেশের যা অবস্থা, যে ভাবে বিভেদ বিভাজন ঘটানোর চেষ্টা চলছে, সেই সময়ে এই জাঠা এক নতুন আশার আলো দেখাচ্ছে।

এখান থেকে এগিয়ে জাঠা বিজয় কুমার উপাধ্যায়ের কোচিং সেন্টারের সামনে এসে থামে, যেখানে ছাত্রছাত্রীরা অংশ গ্রহণ করেন। সেখানে শিবানী, হিমাংশু, বিজয় আর অন্য সাথীরা ‘গঙ্গা কি কসম, যমুনা কি কসম, ইয়ে তানা-বানা বদলেগা, তু খুদ কো বদল, জমানা বদলেগা’ গান শোনান। শিবানী, হিমাংশু, আমন, সঞ্জয়, পূজা শোনান ‘হাম ঢাই আখর প্রেম পড়নে অউর পড়ানে আয়ে হ্যায়/ হাম ভারত সে নফরত কা হর দাগ মিটানে আয়ে হ্যায়’ এবং ‘দিল সে দিল কা নাতা জোড়ো, ভারত জোড়ো, ভারত জোড়ো’ গানগুলি। বিজয় কুমার উপাধ্যায় ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে নিয়ে স্লোগান দেন, নফরত ছোড়ো, দিল সে দিল কা নাতা জোড়ো’।

তিনি বলেন, এখানে এক ডজনের বেশি মসজিদ আছে, আর আছে অনেক মন্দির। সবাই মিলেমিশেই বাস করেন। একে অপরের সুখ দুঃখে ভাগীদার হন। মানুষের নিজের বিশ্বাস নিয়ে বাঁচার অধিকার আছে। এই গ্রাম আমাদের। তাকে পবিত্র রাখা, তার সঙ্গে ভালবাসা জড়িয়ে রাখা, এটাই আমাদের জীবনের মূল সুর। জাঠার সাথীরা এর পর ‘তু জিন্দা হ্যায় তো জিন্দেগি কি জিত পে একীন কর,/ অগর কহি হ্যায় স্বর্গ তো উতার লা জমিন পর’ গান পরিবেশন করেন। মায়া একটি কবিতা শোনান, যাতে বলা হয়, ‘হাম বেটি হ্যায়, অভিশাপ নেহি’। শেষ পর্বে রীতেশ গ্রামবাসীদের অনুরোধ করেন, আপনারাও আমাদের সঙ্গে চলুন, গান করুন, কবিতা শোনান। ছাত্রছাত্রীরা বলেন, এই জাঠা তাদের নাড়া দিয়েছে। ‘এই সবকিছুই আমাদের জন্য, আমাদের দেশের জন্য হচ্ছে। একে স্বাগত জানানো উচিত’।

জাঠা পরের গন্তব্য মাধোপুর মঠের (তুরকোলিয়া) সরকারি মধ্য বিদ্যালয়ে পৌঁছায়। সেখানে স্কুলের প্রাঙ্গনেই জাঠার সাথীদের স্বাগত জানান স্কুলের প্রধান শিক্ষক। স্কুলে প্রায় ছয়শো ছাত্রছাত্রী ছিলেন। তাদের মধ্যেও দারুণ উতসাহের পরিচয় পাওয়া গেল। হিমাংশু তার সাথীদের নিয়ে গান শোনালেন। তুরকোলিয়ায় দুপুরের খাবার খেয়ে জাঠা আগে এগোল। প্রায় ৪৫ মিনিট চলার পর পদযাত্রা ব্যায়রিয়া বাজারে এলে প্রচারপত্র বিলি করা হল। লোকেদের কাছে এই যাত্রার উদ্দেশ্য বর্ণনা করা হল। এর পর জাঠা গেল পিপরিহা। সেখানেও গান ও বক্তব্যের মাধ্যমে যাত্রার উদ্দেশ্য জানানো হল।

একটি বিষয় বলতেই হয়। এই এলাকায় যা দেখা গেল, তা হল দারিদ্র্য আর বেকারত্ব। ফসল ভালই হয়। চাষিরা ছোট ছোট জমির মালিক। রোজগারের উপায় নেই বলে যুবকরা বাইরে গিয়ে কাজ করেন। গ্রামে শৌচালয় নেই। ছোট ছোট ঝুপড়ি ঘরে বাস। সরকারি সুবিধাগুলি সবার কাছে পৌঁছায়নি। আরেকটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হল, এখানকার মানুষ গান্ধীজির বিষয়ে, ভগত সিং আর বাবাসাহেবের বিষয়ে জানেন। জাঠার সঙ্গে আগের দিন থেকেই পূর্ব চম্পারণের বীরেন্দ্র মোহন ঠাকুর রয়েছেন। তিনি শুধু চলছেনই না, পরের গন্তব্যে পৌঁছতে সহায়তা দিচ্ছেন। জাঠা পিপরিহা থেকে রাত্রিবাসের গন্তব্য সপহিতে সাড়ে ছটা নাগাদ পৌঁছায়। সেখানে পঞ্চায়েত ভবনে জাঠার লোকেদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছিল।

সাড়ে ছয়টায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে প্রথমে নিসার আলী আর দেবনারায়ণ সাহু ছত্তিশগড়ের নাচা-গম্মত শৈলীর নাটক ‘ঢাই আখর প্রেম’ মঞ্চস্থ করেন। এটি যেহেতু ছত্তিশগড়ের নাট্যশৈলীতে, তাই এর নতুনত্ব দর্শকদের মনোরঞ্জন করে। গোটা যাত্রাপথেই এই নাটক খুব জনপ্রিয় হয়েছে। যেই গ্রাম হয়েই যাক, সেখানেই ছত্তিশগড়ের অভিনেতাদের এই নাটক অভিনয় করতে হচ্ছে। এর সঙ্গেই জাঠার সঙ্গী নিসার আলী কবীর, রহিম, আদম গোণ্ডবী প্রমুখের দোহা, গজল ইত্যাদি আবৃত্তি করেন এবং নাটকের মূল বার্তা জনতার কাছে পৌঁছে দিচ্ছেন।

রীতেশ পদযাত্রার বার্তার বিষয়ে গ্রামবাসীদের বিস্তারিত বলেন। এর পর ছিল গানের অনুষ্ঠান। প্রথম গান ছিল ‘গঙ্গা কি কসম, যমুনা কি কসম, ইয়ে তানা-বানা বদলেগা/ তু খুদ কো বদল, তব ইয়ে জমানা বদলেগা’ এবং পরের গান ছিল ‘ঢাই আখর প্রেম কে পড়নে আউর পড়ানে আয়ে হ্যায়,/ হাম ভারত সে নফরত কা হর দাগ মিটানে আয়ে হ্যায়’। এ ভাবেই সিপহা বাজারে লোকদের সঙ্গে বার্তালাপ সমাপ্ত হয়। কারণ অনুষ্ঠান চলাকালেই বিদ্যুৎ চলে যায়। তা সত্বেও গ্রামবাসীরা খাবার বানানো, যাবতীয় বন্দোবস্ত করা, যাত্রার সাথীদের গান বাজনার রিহার্সাল করানো আর রিপোর্ট লেখার কাজে সম্পূর্ণ সহায়তা দিয়ে গিয়েছেন।


১২ অক্টোবর, ২০২৩, বৃহষ্পতিবার

সকালে যাত্রা সপহি গ্রাম থেকে পরের গন্তব্যে রওনা হয়। এই জাঠা পারস্পরিক প্রেম, শান্তি আর সৌহার্দ্যর উৎসব, যা সমাজে পরিব্যপ্ত ঘৃণা, অবিশ্বাসের ভাবনার জবাবে আমাদের সংস্কৃতি কর্মীদের আর নাগরিকদের একটি জরুরি উদ্যোগ। গ্রামগুলির কিছু লেখাপড়া জানা যুবকদের সঙ্গে কথা বলায় তারা নিজেদের মতামত ব্যক্ত করেছেন। তারা বলেন, ‘কিছু শক্তিশালী দেশ দুর্বল দেশগুলিকে শেষ করে দিতে চাইছে। চারদিকে যুদ্ধের বিভীষিকা। ইসরায়েল যেভাবে গাজা ভূখণ্ডে প্যালেস্তাইনের জনগণকে খতম করছে, তা খুবই দুশ্চিন্তার। আমরা আপনাদের জাঠার উদ্দেশ্যর পাশে আছি। আমরাও বিশ্বে যুদ্ধ আর হিংসা চাই না। আমরা যুবক, কিন্তু আমাদের স্বপ্নকে খতম করা হচ্ছে। চাকরি নেই, রোজগার নেই। লেখাপড়া শিখে সামান্য আয়ের কিছু না কিছু কাজ খুঁজে কোনও রকমে শ্বাস নেওয়ার চেষ্টা করছি’।

পদযাত্রার সময়ে গ্রামবাসীরা স্থানীয় এলাকার ঐতিহাসিক তাৎপর্য শুনিয়ে যাচ্ছেন। সপহি থেকে যাত্রা রওনা হওয়ার আগে শুম্ভু সাহনি বলেন, সপহি বাজারে যেখানে আমরা রাতে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করেছি, সেখানে আগে একটা কুঁয়ো ছিল, যার জল ছিল বিষাক্ত। পূর্বপুরুষরা বলে গেছেন, আগে ইংরেজরা এখান দিয়ে যাওয়ার সময় পানীয় জল চাইতো, কিন্তু গ্রামবাসীরা কুঁয়োর জল তাদের দিত না। বলতো, ওই জল পান করলে বাঁচার সম্ভাবনা থাকবে না। পূর্বপুরুষরা সব রকম ভাবে ইংরেজের বিরুদ্ধে নিজেদের অবস্থান নিয়েছেন। সামনে থেকেও লড়েছেন, অন্যভাবেও বিরোধিতার সুযোগ ছাড়েননি। সেই কুঁয়ো আজও আছে। এই কুঁয়োকে ‘তিতবহা ইনার’ বলা হয়। তিনি বলেন, একটি গানে ‘মত মুঅ মত মাহুর খা, মেরে কো হোখে তো সপহি যা’। এই কাহিনি আমাদের আমাদের পূর্বজরা শুনিয়েছেন। আজও এই এলাকার মানুষের মনে এই বিশ্বাস আছে। আজও সপহির মানুষ উন্নয়নের প্রতীক্ষায়। সরকারি অর্থের লুট চলছে। গরিবের সংখ্যাই খুব বেশি। অন্যদিকে ধর্মের নামে নানা কাজকর্ম প্রাধান্য পাচ্ছে। শিক্ষার হাল খুব খারাপ। লোকদেখানো বিকাশ হচ্ছে, কিন্তু খুব কম লোক তার সুফল পাচ্ছেন। এখানে ইংরেজ একসময় নীল চাষ করাতো আর তার সঙ্গে চলতো দমন পীড়ন।

১২ অক্টোবর যাত্রার পরবর্তী গন্তব্য ছিল সপহি বেরেতিয়া ( ৫ নং ওয়ার্ড)। সেখানকার চকে জাঠার উদ্দেশ্য নিয়ে গ্রামবাসীদের সঙ্গে কথা হল। জাঠার সবাই হিমাংশুর নেতৃত্বে ‘ঢাই আখর প্রেম পড়নে আউর পড়ানে আয়ে হ্যায়’ এবং ‘গঙ্গা কি কসম, যমুনা কি কসম, ইয়ে তানা-বানা বদলে গা, তু খুদ কো বদল, তব তো ইয়ে জমানা বদলে গা’ গানদুটি গেয়ে শোনান। এর পর জাঠা গিয়ে বেনারসী চকে থামে। সেখানে দুপুরের খাবার খেয়ে এগিয়ে চলে। আজগড়ি গ্রামের অরবিন্দ কুমার এবং পচরুয়া গ্রামের মনোজ কুমার সিং পশ্চিম মুখলিসপুরে জাঠার নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। অরবিন্দজি আগে মুখিয়া ছিলেন। তিনি জাঠাকে সসম্মানে স্বাগত জানান এবং গোটা পথে নানা স্থানের লোকের সঙ্গে পরিচয় করাতে করাতে জাঠাকে উজ্জীবিত রাখেন।

জাঠা পৌঁছায় বতখ মিয়াঁর মাজারে। মসজিদের পাশেই মাজার। বতখ মিয়াঁর সম্পর্কে জানানো হয়। গান্ধীজি যখন মোতিহারিতে এসেছিলেন, তখন ইংরেজ তাঁর পানীয় দুধে বিষ মিশিয়ে তাঁকে হত্যার ষড়যন্ত্র করেছিল। সেই ষড়যন্ত্রের কথা বতখ মিয়াঁ শুনে ফেলেন। প্রথমে তিনি কাঁদতে থাকেন। পরে গান্ধীজিকে গিয়ে সেই কথা জানিয়ে তাঁকে দুধ না খেতে অনুরোধ করেন। গান্ধীজি উপবাসের বাহানায় সেই দুধ পান না করে ফিরিয়ে দেন এবং তার প্রাণ বেঁচে যায়। এখানকার মানুষের বিশ্বাস, গান্ধীজি না বাঁচলে ভারত স্বাধীনতা পেত না। এই ঘটনার নানা কাহিনি স্থানীয় মানুষের মুখে মুখে প্রচারিত, জাঠার সাথীরা সেগুলি ভিডিও করে রেখেছেন।

ওখানে মোহম্মদ হাজী আনসারী, সাহেব কাজী আর মৌলানা সালাউদ্দিন রিজভি ইমাম সাহেবের সঙ্গে পরিচয় হয়। তিনি জানান, বতখ মিয়াঁর চিহ্ন মুছে দেওয়ার অনেক অপচেষ্টা হয়েছে। বতখ মিয়াঁর নাতি হায়দর আনসারী আজও গ্রামেই থাকেন। তার নিজের কোনও জমি নেই, তার সন্তান বিকলাঙ্গ। স্ত্রীর নাম নবাজন খাতুন। এরা বতখ মিয়াঁর ভাইয়ের পরিবার। আজগড়ি গ্রামের মানুষ আজও গান্ধীজি এবিং বতখ মিয়াঁ আনসারীর স্মৃতি এইভাবেই বাঁচিয়ে রেখেছেন। গোটা ইতিহাস লোকস্মৃতিতে রক্ষিত আছে। এমন অনেক প্রবীণকে পাওয়া গেল, যারা বলেছেন, তাদের নেতা আজও গান্ধীজিই। কিছু মানুষ গান্ধীজি আর বতখ মিয়াঁর স্বপ্নের ভারত তৈরির পথে বাঁধা সৃষ্টি করছে।

এবার জাঠা পৌছায় সিসবা। রাস্তায়, বাজারে অনেক মানুষের সঙ্গে কথা বলে জাঠা এগিয়ে চলে। রাত হয়ে আসছিল। জাঠার সাথীরা গান গাইতে গাইতে রাত্রিবাসের ঠিকানা সিসবাতে পৌঁছালেন। সেখানে পঞ্চায়েত ভবনে থাকার ব্যবস্থা হয়েছিল। সিসবার প্রাক্তন বিধায়ক রামাশ্রয় প্রসাদ সিং, আমিরুল হুদা, মঞ্জুরিয়া ব্লকের প্রধান জফির আজাদ চমন প্রমুখ অন্যান্য সঙ্গীদের নিয়ে জাঠার যাবতীয় দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। কিছুক্ষণ এখানে থেকে জরুরি কাজকর্ম সেরে সাড়ে আটটা নাগাদ জাঠা সিসবা চকের কাপাহরিয়া টোলায় পৌঁছায়। সেখানে আগে থেকেই লোকজন অপেক্ষায় ছিলেন। জাঠার আসার কথা তারা জানতেন। খুব উতসাহের পরিবেশ ছিল। এটিও মুসলিম প্রাধান্যের এলাকা। এখানকার পারস্পরিক একতা উল্লেখনীয়।

এখানে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের সূচনা হল ‘জোগিরা’ গান দিয়ে। পীযূষ শুরু করতো, আর পুরো টিম তার সঙ্গে গাইত। আর ‘জোগিরা সা-রা-রা-রা-রাঃ’-র সঙ্গে শ্রোতারাও হাততালি দিয়ে দুলে দুলে গলা মেলাতেন। এর পর রীতেশ শ্রোতাদের উদ্দেশ্যে বক্তব্যে জাঠার উদ্দেশ্য বর্ণনা করেন। এর পর বলেন ইপ্টার সর্বভারতীয় সম্পাদক শৈলেন্দ্র। তিনি বলেন, ‘এখন গান্ধীজি, ভগত সিং এর ঐতিহ্যকে বাঁচানোর সময়। আজ আমরা যেখানে দাঁড়িয়ে আছি, সেই এলাকা গান্ধীজি আর কৃষক মজুরের এক মহান মিলনস্থল। এটা গান্ধীজি আর তার সাথীদের কর্মক্ষেত্র। আজ এই ভূমিকে, আমাদের দেশকে, ঘৃণার আখড়া বানানো হচ্ছে। আমি ছোটবেলায় একটি ভজন গান শুনেছিলাম, ‘মন তড়পন হরি দরশন কো আজ’। এটি মোহম্মদ রফি গেয়েছিলেন। লিখেছিলেন শকিল বাদায়ুনি আর সুরকার ছিলেন নৌশাদ। এরা সব দূরত্ব দূর করেছিলেন। এই দেশ এভাবেই ধীরে ধীরে তৈরি হয়েছে। আমীর খসরু, সুফি-সন্তদের দীর্ঘ পরম্পরা, গালিব, মীর, নিরালা, কালিদাস প্রমুখের সৃজনে এই গোলাপ বাগিচা তৈরি। স্বাধীনতা আন্দোলনে ভগত সিং আর গান্ধীজির বিচারধারার ভিন্নতা ছিল, তাদের পথ আলাদা ছিল, কিন্তু দুজনই একই সময়ে দেশের স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করেছেন। শুধু স্বাধীনতাই নয়, সমনতা, সাম্যের সঙ্গে আজাদী, শ্রমিক কৃষকের আজাদী, সামন্তবাদের শিকল থেকে মেয়েদের আজাদী! দুজনই ভারতকে একটি ধর্মনিরপেক্ষ দেশ হিসাবে দেখতে চেয়েছিলেন। আমরাই তাদের প্রকৃত উত্তরাধিকারী। সেই সংগ্রাম আর স্বপ্নকে রক্ষা করতে আপনাদের সঙ্গে যুক্ত হতে এসেছি আমরা। গান্ধীজির কাছে ছিল নৈতিক শক্তি। আমরা ভালবাসার আহ্বান নিয়ে আপনাদের কাছে এসেছি।

সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের সূত্রপাত হয় লক্ষ্মীপ্রসাদের ‘শোনেবালে জাগ, সময় অঙ্গড়াতা হ্যায়’ (ঘুমিয়ে থাকা মানুষ, জাগো, সময় আড়মোড়া দিচ্ছে) গানে। তার পর শোনান ‘বড়ে চলো জওয়ান, তুম বড়ে চলো’ গান। প্রাক্তন বিধায়ক রামাশ্রয় প্রসাদ তার ভাষণে বলেন, ‘আমি নতুন চারাদের দেখতে পাচ্ছি, এটা আমার সৌভাগ্য। এদের দেখে বিশ্বাস হচ্ছে যে, এখনও দেশের ভাগ্য নিরাপদে আছে। যতদিন ছোটরা এক সুরে একসঙ্গে থাকার শপথ নেবেন, ততদিন আমাদের কেউ পরাস্ত করতে পারবে না’। ফের লক্ষ্মীপ্রসাদ ‘ক্যায়সে জইবে গে সজনিয়া পাহাড় তোড়ে লা হে/ হামার অঙ্গুরি সে খুনবা কে ধার বহেলা’ গেয়ে শোনান। রীতেশ স্থানীয় লোকেদের জাঠার সঙ্গী হওয়ার আহ্বান জানান। গ্রামপ্রধান চমনজি বলেন, ‘ঢাই আখর প্রেম এর উদ্দেশ্য আপনারা সবাই জানেন। আপনি যতই উন্নয়ন করুন, তাতে যদি প্রেম আর বিশ্বাস না থাকে, সেই বিকাশের কোনও অর্থই থাকে না। এই স্থান গান্ধীজির কর্মভূমি। তিনি আমাদের প্রেম আর ত্যাগের পাঠ দিয়েছেন। আমাদের সাংস্কৃতিক বৈচিত্রের সাজেই আমাদের বেশি সুন্দর লাগে’।

নিসার আলী আর দেবনারায়ণ সাহু ছত্তিশগড়ের নাচা-গমত লোকনাট্য শৈলীতে ‘ঢাই আখর প্রেম’ নাটক মঞ্চস্থ করেন। দর্শকদের উতসাহ ছিল দেখার মতো। স্থানীয় লোকেদের কাছে নাচা-গম্মত একেবারে নতুন ধরণের উপস্থাপনা। ছোটদের এতই ভাল লেগেছে যে, ওরা এর সঙ্গে নাচতে শুরু করে। নাটকের মধ্যে মধ্যেই কবীর আর রহিমের দোঁহা, আদম গোণ্ডবির গজল গানও ছিল। এর পর হিমাংশু ও বাকি সাথীরা ‘ঢাই আখর প্রেম পড়নে আউর পড়ানে আয়ে হ্যায়/ হাম ভারত সে নফরত কা দাগ মিটানে আয়ে হ্যায়’ গেয়ে শোনান। বিহারে ঢাই আখর প্রেম পদযাত্রার এদিন ছিল ষষ্ঠ দিন।


১৩ অক্টোবর, ২০২৩, শুক্রবার

বিহারে ঢাই আখর প্রেম পদযাত্রায় সিসবা পূর্ব পঞ্চায়েতে রাত্রিবাস করে সপ্তম দিন সকালে প্রভাতফেরী হিসেবে বের হল। সেই সময়েও গ্রামবাসীদের সঙ্গে চলল আলাপচারিতা। দেখান থেকে আমাদের পরবর্তী গন্তব্য সুরহাঁর জন্য জাঠা রওনা হল। জাঠার সাথীরা ‘গঙ্গা কি কসম, যমুনা কি কসম, ইয়ে তানা-বানা বদলেগা/ তু খুদ কো বদল, তু খুদ কো বদল, তব তো জমানা বদলেগা’ গাইতে গাইতে যাত্রা শুরু হল। জাঠার সাথীদের চোখে মুখে এই বিশ্বাস স্পষ্ট যে, সময় যতই খারাপ হোক না কেন, এই বিশ্বকে দূষিত করার জন্য যতই অপচেষ্টা হোক না কেন, আমরা প্রত্যেক নাগরিকের কাছে পৌঁছে নিজেদের সাংস্কৃতিক পরম্পরার কথা বলে যাব। আমাদের যে বহুবর্ণের বুনোট, তাঁকে বাঁচানোর জন্য আমরা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। জাঠার সকলেই, যুবক হোক বা প্রবীণ, সবার পা উতসাহের সঙ্গে একই তালে পড়ছে। কাউকে পরিশ্রান্ত মনে হচ্ছে না।

অন্তিম পর্বে মোতিহারির দিকে চলা, আমাদের বাপুর কর্মভূমির দিকে। এমনিতে তো এই গোটা এলাকাতেই বাপুর পদচিহ্নর অনুভূতি হয়। এখানকার মাটি বাপুর ত্যাগ আর বলিদানের সৌরভে সুরভিত। আজও প্রত্যেক গ্রাম গান্ধীজিকেই নিজেদের সবকিছু বলে মনে করে।

ঢাই আখর প্রেম সাংস্কৃতিক পদযাত্রা সিসবা থেকে সুরহাঁর পথে লোকজনের সঙ্গে কথা বলতে বলতে এগোল। পথে কথা হল হরিহর প্রসাদ, বাবুলাল মাহাতো, খেদু মাহাতোর সঙ্গে। এরা সবাই মজুর। তারা সবাই যাত্রাকে পূর্ণ সমর্থন দিলেন। তারা বলেন, ‘সবাই যদি ভালবাসার পরিবেশ গড়ার শপথ নেন, তাহলে এই আততায়ী সময় দ্রুত সমাপ্ত হবে। আমাদের গ্রাম খুব গরিব। গোটা গ্রামের জনসংখ্যা ১২০০-র মতো, কিন্তু চাকরি করেন মাত্র ৪ কি ৫ জন। বেশিরভাগ মানুষ মোতিহারি শহরে গিয়ে রোজগারের উপায় খুঁজছেন। আমাদের জমি সামান্যই, তাতেই আমরা গম, ধান, মকাই, আখ ইত্যাদি চাষ করে প্রাণ ধারণ করছি। প্রতি বছর এখানে বন্যা হয়। গত দু বছর বন্যা না হওয়ায় ধান চাষ করা যাচ্ছে। যখন বন্যা আসে, মানুষ নিজের গৃহপালিত পশু আর যা কিছু সম্পদ বাঁচানো যায়, তাই নিয়ে নিরাপদ স্থানে যেতে বাধ্য হয়। এখানে বাচ্চাদের পড়ার জন্য একটাই মিডল স্কুল আছে। কিন্তু গ্রামের বৈশিষ্ট হল, সবাই এখানে মিলেমিশে বাস করেন। একে অপরকে সহায়তা করেন। পরস্পরকে মদত করা ছাড়া আমাদের আর আছেটাই বা কি? আমরা যদি নিজেদের ভ্রাতৃত্ব আর প্রেমকে ভুলে যাই, তাহলে বাঁচবো কী করে?’

জাঠার যুবক সাথীরা এমন এক জীবনচর্যার দৃশ্য প্রথমবার দেখছিলেন। শহরে যে জীবন দেখা যায়, তাতে ঔজ্জ্বল্য আছে, আর তার জন্য গ্রামকে বলি হতে হয়। এখানে বটগাছের নিচে জাঠার সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান শুরু হল। চলাফেরায় অসমর্থ রামদেব গিরি লাঠির সাহায্যে পথ হেঁটে এলেন সেই জায়গায়। কেউ কেউ জল এনে দিলেন, গ্রামের মেয়েরা চেয়ার নিয়ে এলেন বাড়ি থেকে। যার কাছে যা আছে, যতটুকু আছে, তাই নিয়ে এসে জাঠার সঙ্গে একতার প্রমাণ দিচ্ছিলেন। তারা গরিব মানুষ, সামর্থ্য সীমিত, এরা সবাই দালালদের শোষণে মৃতপ্রায়। কিন্তু তাদের জিজীবিষা আর ভালবাসার প্রতি নিষ্ঠা নতুন আশা জাগায়।

গ্রামবাসীরা চকে দাঁড়িয়েই অনুষ্ঠান দেখছিলেন। অনুষ্ঠান তাদের খুব পছন্দ হয়েছে। রীতেশ রঞ্জন তাদের ঢাই আখর প্রেম পদযাত্রার উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলেন। এর পর শিবানী আর তার সাথীরা ‘ঢাই আখর প্রেম পড়নে আউর পড়ানে আয়ে হ্যায়/ হাম ভারত সে নফরত কা হর দাগ মিটানে আয়ে হ্যায়’ এবং ‘গঙ্গা কি কসম, যমুনা কি কসম,/ ইয়ে তানা-বানা বদলেগা,/ তু খুদ কো বদল, তব তো জমানা বদলেগা’ গেয়ে শোনান। নিসার আলী তার বক্তব্যে বলেন, ‘আমরা দূর দূর থেকে হেঁটে আসছি। একটিই বার্তা নিয়ে এসেছি। এখন বাজারের সময়, কেনা বেচার সময়। এই সময়ে আমাদের বিকল্প খুঁজতে হবে। এই বাজার মানুষকে, মানুষের সংস্কৃতিকে একটি পণ্য বা ভোগের বস্তু বানিয়ে দিচ্ছে। তাঁকে বদলাতে হবে।’

জাঠা সেখান থেকে চলা শুরু করে সন্ধে ৬টায় মোতিহারি শহর হয়ে এনসিসি ক্যাম্পাস রাজা বাজারে পৌঁছায়। সেখানে পথের ধারে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়। সবার আগে প্রবীণ সাথী রাজেন্দ্র প্রসাদ ‘লিহলে দেশবা কে আজাদিয়া, খাদিয়া পহন কে জি’ এবং ‘হামারা হিরা হেরা গইল কচরে মে’ গান গেয়ে শোনান। এর পর নিসার আলী আর দেবনারায়ণ সাহু ছত্তিশগড়ি শৈলীতে ‘ঢাই আখর প্রেম’ নাটক অভিনয় করেন। এর পর ‘রাহোঁ পর নিলাম হামারি ভুখ নেহি পায়েগি/ আপনি কৌশিস হ্যায় কি অ্যায়সে সুবহ ইহা পর আয়েগি’ গান গেয়ে মনোরঞ্জন করে।

ইপ্টার সর্বভারতীয় সম্পাদক শৈলেন্দ্র কুমার মহাত্মা গান্ধীর উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, “বাপু নিজেকে হিন্দু বলে গণ্য করতেন আর তা স্পষ্টভাবেই বলতেন। কিন্তু একথাও জোর গলায় বলতেন যে, তিনি নিজেকে শুধু হিন্দু বলেই মনে করান না, বরং খ্রিষ্টান, মুসলমান, ইহুদি, শিখ, পার্শি, জৈন বা অন্য যে কোনও ধর্মের অনুসারী বলেও মনে করতেন। এর অর্থ হল, ‘আমি অন্য সব ধর্মের ভালোটুকু নিজের মধ্যে গ্রহণ করেছি। এভাবে সব ঝগড়া থেকেও বেঁচেছি আর ধর্মের কল্পনাকেও প্রসারিত করেছি’। তিনি একথা বলেছিলেন ১৯৪৭ সালের ১০ জানুয়ারি। অর্থাৎ, কোনও একটি ধর্ম মানার অর্থ এই নয় যে, আমরা অন্য ধর্মের বিরুদ্ধে হয়ে যাব। আমাদের একসঙ্গে থাকতে হলে পরস্পরের সঙ্গে ভালবাসার সম্পর্কে জড়িয়ে থাকতে হবে।

উল্লেখ্য, ১৪ অক্টোবর মোতিহারিতে ঢাই আখর প্রেম পদযাত্রার সমাপন হয়। রীতেশ রঞ্জন সবাইকে সমাপ্তি অনুষ্ঠানে আসার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। বিহার ইপ্টার কার্যনির্বাহী সাধারণ সম্পাদক ফিরোজ আহমদ খান বলেন, সমাপ্তি অনুষ্ঠানে বন্ধুত্বের কথা হবে, সমানতার কথা হবে, কথা হবে ঢাই আখর প্রেম-এর। এক সময় পদযাত্রা মোতিহারি পৌঁছায়। মোতিহারির গান্ধী সংগ্রহালয়ে ১৪ অক্টোবর বেলা ২ টোয় সমাপ্তি অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল।


১৪ অক্টোবর, ২০২৩, শনিবার

এই দিন ঢাই আখর প্রেম পদযাত্রা শুরু হয় প্রভাতফেরী করে। সকাল ৭টা থেকে জাঠার সাথীরা শহরের নানা পথ পরিক্রমা করে মোতিহারিতে গান্ধীজির কাজকর্মের স্মৃতিস্থলে পৌঁছায়। এই জায়গায় সঙ্গে কেবল চম্পারণ সত্যাগ্রহই নয়, নীল চাষের সঙ্গে জড়িত কৃষকদের বেদনা ও সংগ্রামের স্মৃতিও জড়িত। স্বাধীনতা আন্দোলনে গান্ধীজির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার অনেক স্মৃতি জাগরুক রয়েছে মোতিহারিতে। সেই সব স্মৃতি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের থেকে মুক্তির আন্দোলনে তার সাফল্যের কাহিনির জীবিত দস্তাবেজ। মানুষ গ্রামে গ্রামে গান্ধীজির সংগ্রামের সঙ্গে পায়ে পা মিলিয়ে চলেছেন।

চম্পারণ সত্যাগ্রহ ১৯১৭ সালে জাতির জনক মহাত্মা গান্ধীর সত্য আর অহিংসার ভিত্তিতে শুরু করা প্রথম সত্যাগ্রহ। এই সত্যাগ্রহের সঙ্গে সঙ্গেই ভারতীয় রাজনীতিতে গান্ধী যুগের সূত্রপাত। এই আন্দোলনে জাতি, সম্প্রদায়, ধর্ম, লিঙ্গভেদ বা আঞ্চলিকতাবাদের কোনও জায়গা ছিল না। আজ ঢাই আখর প্রেম পদযাত্রা বিহারে শেষ হচ্ছে। এই জাঠার সুত্রপাত ৭ অক্টোবর ২০২৩ পাটনার রেলওয়ে স্টেশনে গিয়ে গান্ধীজির মূর্তিতে পুষ্পার্ঘ্য দিয়ে শুরু হয়েছিল। কলকাতা থেকে চম্পারণ যাওয়ার পথে ১৯১৭-র ১০ এপ্রিল এই পাটনা স্টেশনেই (আগের নাম বাঁকিপুর জংশন) গান্ধীজি এসে পৌঁছেছিলেন। ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে চলমান নীল আন্দোলনের মহান স্বাধীনতা সংগ্রামী রাজকুমার শুকুলের সঙ্গে মহাত্মা গান্ধী ১৯১৭-র ১০ এপ্রিল সকালে পাটনায় পৌঁছান এবং নীল চাষ সম্পর্কিত তথ্যাবলি জানতে জানতে মুজফফরপুর হয়ে চম্পারণ পৌঁছান। সেই স্মৃতিকে মনে রেখেই বিহারে জাঠা পাটনা রেলস্টেশন থেকে শুরু হয়ে গান্ধী ময়দানে গিয়ে ভগত সিং এবং গান্ধীজির মূর্তিতে মাল্যদান করা হয়। সাংস্কৃতিক কর্মীরা গান ও নাটকের মাধ্যমে মানুষের হৃদয়ের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করেন।

মোতিহারিতেও ১৪ অক্টোবর সকালে প্রভাতফেরী দিয়েই মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক গাঁথা হয়। গান গাইতে গাইতে জাঠার সাথীরা দুপুর ২টোয় ফের ফিরে আসার অঙ্গীকার নিয়ে রাত্রিবাসের জায়গায় ফিরে আসেন।

এই ঢাই আখর প্রেম সাংস্কৃতিক পদযাত্রার প্রত্যেক সাথীই অনেক নতুন কিছু শিখেছেন। এই যাত্রা নিজের দেশকে জানতে, বুঝতে, তার বহুত্বধর্মী সাংস্কৃতিক রূপকে দেখতে আর বুঝতে সহায়ক ছিল। নানা পরিস্থিতিতে আমাদের সমাজ কীভাবে বেঁচে থাকে, কত কঠিন পরিস্থিতিতেও নিজেদের একতা অটুট রাখেন, এই জাঠা তা শিখেছে।

চম্পারণের কোনায় কোনায় কোথাও কস্তুরবা আছেন, কোথাও রাজকুমার শুকুল, কোথাও গোরখ প্রসাদ, শেখ গোলাম, লোমরাজ সিং, হরিবংশ রায়, শীতল রায়, আবার কোথাও ধরণীধর প্রসাদ তো কোথাও রামনবমী বাবু আর কোথাও বতখ মিয়াঁ আনসারী আছেন। চম্পারণের গান্ধী সত্যাগ্রহ আরেকটি শিক্ষা দিয়েছিল যে, নিজেদের মধ্যে একতা, ভালবাসা বিরাট বড় বড় লড়াই জিততে সহায়ক হয়। একই সঙ্গে আমাদের অবিশ্বাস, আমাদের ঘৃণা, জনসমাজে বিচ্ছিন্নতা বিভাজনের দিকে ঠেলে দিতে পারে। এই কারণেই ১৯৪৭-এ এক কোটি তিরিশ লাখ মানুষ ঘরহীন হয়েছিলেন, হাজার হাজার মানুষ খুন হয়েছেন, মহিলাদের ধর্ষণ করা হয়েছে। এমন বিভীষিকার দিন কাটিয়েছে দেশ। যে একতায় জনতা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদকে পরাস্ত করেছিল, তাকেই ক্ষুদ্র স্বার্থ আর ঘৃণার কারণে নিজেরাই পরাস্ত করেছিল। চম্পারণ এই শিক্ষা দিয়েছে, যা জাঠার সব সাথী কেবল অন্তর থেকে গ্রহণই করেনি, শিখেছেন। আমাদের একতা, আমাদের ভালবাসাই আমাদের শক্তি। যুদ্ধের দ্বারা বিশ্বকে জয় করা যায় না, চম্পারণ থেকে এটাই ছিল গান্ধীজির সবথেকে জরুরি বার্তা। আমাদের জাঠার সাথীরা এই শিক্ষা অন্তরে নিয়ে ব্যাষ্টি থেকে সমষ্টিতে যুক্ত হওয়ার আত্মবিশ্বাস নিয়ে ফিরছেন। 

সমাপ্তি অনুষ্ঠানের শুরুতে বিহার ইপ্টার কার্যনির্বাহী সাধারণ সম্পাদক ফিরোজ আশরফ খান বলেন, “ঢাই আখর প্রেম জাঠা কবিতা, গান, নাটক, আলোচনার মাধ্যমে জনসম্পর্ক করা হয়েছে। এই পদযাত্রার সমাপ্তিতে আপনাদের সবাইকে হৃদয় থেকে স্বাগত জানাই। প্রেম, সদ্ভাব আর সম্প্রীতি বজায় রাখতে সমস্ত ধর্মনিরপেক্ষ শক্তি একসঙ্গে এই যাত্রার আয়োজন করেছে। এই যাত্রা থেকে আমরা অনুভব করেছি যে, আজও কৃষকের সমস্যা যেখানে ছিল, সেখানেই আছে। সরকার কৃষকের হিতে একেবারেই নজর দেয় না, শুধু লোকদেখানো উন্নতির দাবি করে। কৃষকের নামে যে সব কর্মসূচি নেওয়া হয়, কৃষকের লাভের নামে যে সব নীতি বানানো হয়, তার লাভ খেয়ে যায় মধ্যসত্ত্বভোগী দালালরা। কৃষকের নামে এই লুটে সরকারগুলি, আমলাতন্ত্র এবং দালালরা সবাই একজোট হয়েই আছে।

ঢাই আখর প্রেম পদযাত্রার স্থানীয় সংযোজক অমর জি যাত্রাকে সফল করতে নিরলস পরিশ্রম করেছেন। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত জাঠায় অংশ নেওয়া সাথীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘চম্পারণের মাটিকে আপনারা বেছে নেওয়ার জন্য আমরা চম্পারণের মানুষ আপনাদের আরেকবার অভিনন্দন জানাই। আজকাল দেশে যেভাবে বিষাক্ত পরিবেশ তৈরি করা হচ্ছে, সেই সময় গান্ধীজির পদচিহ্ন ধরে চলার যে সিদ্ধান্ত আপনারা নিয়েছেন, তার প্রশংসা করতেই হয়। আপনারা সেই সব জায়গায় গিয়ে মানুষের সঙ্গে কথা বলেছেন, সেই ইতিহাস গড়া মানুষদের গ্রামে গিয়ে বিপ্লবীদের স্মরণ করেছেন, তার জন্য আমি কৃতজ্ঞতা জানাই’। মনোজ কুমার, রামাশ্রয় বাবু, শম্ভু সাহনি, দিগ্বিজয় সিং আর অন্যান্য সাথীদের প্রতি ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন। যাত্রীদের রাস্তায় এরাই থাকা ও খাবারের ব্যবস্থা করেছিলেন। নিজে থেকে এগিয়ে এসে যাত্রাকে যারা সফল করার জন্য উদ্যোগ নিয়েছিলেন, সেই যোগী মাঝি, গঙ্গিয়া দেবী, বিনোদ বাবু, মঙ্কেশ্বর জি, বিনয় কুমার জিকে ধন্যবাদ জানান।

সমাপ্তি অনুষ্ঠান দুপুর ২টোয় শুরু হয়। জাঠার সাথীরা ছাড়াও বহু মানুষ সেখানে অংশ নেন। জাঠার সবাই পদযাত্রা করে গান্ধী সংগ্রহালয়ে পৌঁছান। এর পর শিল্পীরা মঞ্চে নিজেদের সাংস্কৃতিক সম্ভার উপহার দেন।

প্রথম গান ছিল, ‘হাম হ্যায় ইসকে মালিক, হিন্দুস্থান হামারা’। এর পর গান হয় ‘রঘুপতি রাঘব রাজা রাম, পতিত পাবন সীতারাম/ ‘তিন কাঠিয়া লেলেবা পরাণবা, রাম রাম হরে হরে/ ডুবি গইলে সবেরে কিষাণবা, রাম রাম হরে হরে/ রঘুপতি রাঘব রাজা রাম, পতিত পাবন সীতারাম/ বৈষ্ণব জন তো তেনে কহিয়ে, জো পীর পরাই জানে রে’। তৃতীয় গান ছিল ‘গঙ্গা কি কসম, যমুনা কি কসম/ ইয়ে তানা-বানা বদলেগা/ তু খুদ কো বদল, তব তো ইয়ে জমানা বদলেগা’।

এর পর সামাজিক সংস্থা অ্যাকশন এইড এর শারদ কুমারী ভাষণে বলেন, ‘আমি সব পদযাত্রীকে অভিনন্দন জানাই। গোটা বিশ্বেই সহনশীলতা ক্রমশ কমে যাচ্ছে। বিকাশের নামে যে ভাবে বিভেদের পরিবেশ তৈরি করা হচ্ছে, দেশের জন্য তা খুবই ভয়ানক’। কাটিহার কলেজের প্রিন্সিপাল চন্দনা ঝা শারদ কুমারীকে ঝোলা ব্যাগ আর গামছা দিয়ে সম্মানিত করেন। একই সঙ্গে রামায়ণ সিং, হামিদ রাজা, ভরত রায়কেও সম্মানিত করেন চন্দনা ঝা।

রীতেশ রঞ্জনের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে নৃত্য পরিবেশিত হওয়ার পর রাজেন্দ্র প্রসাদ গাইলেন ‘খাদিয়া পহনকে ও বাপু খাদিয়া পহনকে/ লিহল দেশবা কে আজাদিয়া বাপু খাদিয়া পহনকে’। তার পর লক্ষ্মীপ্রসাদ গাইলেন ‘বড়ে চলো তুম জওয়ান, বড়ে চলো, বড়ে চলো’ এবং ‘ক্যায়সে জইবে গে সজনিয়া পাহাড় তোড় লো/ হামারা অঙ্গুরী সে খুনবা কে ধার বহেলা’।

লখনউর সমাজকর্মী নাসিরুদ্দিন প্রশ্ন তুললেন, ‘ঢাই আখর প্রেম পদযাত্রার দরকার পড়ল কেন? কেন আমাদের এভাবে জাঠা নিয়ে ঘুরতে হচ্ছে? কী দরকার ছিল আমাদের? আমাদের জীবন থেকে কি প্রেম ভালবাসা, সহযোগিতার মন মানসিকতা শেষ হয়ে যাচ্ছে? সমাজে কি বৈষম্য বেড়ে যাচ্ছে? আজ মিডিয়া পুরোদমে ঘৃণার প্রসার করছে। ঘৃণার শব্দগুলি বেছে নিচ্ছে। কেবলই ঘৃণা আর বিদ্বেষের জন্ম দিচ্ছে। সোস্যাল মিডিয়া একটি ষড়যন্ত্রের মতো আমাদের জীবন থেকে বন্ধুত্ব, প্রেম, ভালবাসাকে খতম করার কাজ করছে। ঢাই আখর প্রেম পদযাত্রার জাঠা মানবসমাজে প্রেম প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করছে? আমরা বাপুর পদচিহ্ন ধরে চলার চেষ্টা করছি’।

এর পর মনোজ কিছু জাদুর খেলা দেখান। গান্ধী সংগ্রহালয়ের সচিব ব্রজকিশোর জি, জসৌলি পট্টির পারশনাথ জি এবং পরভেজকে সম্মান জানানো হয়। যারা গান্ধীর বিচারধারাকে প্রত্যেক মানুষের কাছে পৌঁছানোর কঠিন উদ্যোগ নিয়েছেন, ব্রজকিশোর জি সেইসব সাথীদের ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন। এর পরের অনুষ্ঠান ছিল রঞ্জন কুমারের ‘ভগত সিং’ নাটক। ভগত সিং এর শেষ চিঠির ভিত্তিতে এই নাটকটি রচিত। অখিলেশ্বর রাম তার ভাষণে বলেন, আজ ঘৃণা আর বিদ্বেষের পরিবেশে গান্ধীজি আমাদের পথপ্রদর্শক হতে পারেন। তার বিচারধারাকে প্রত্যেক মানুষের কাছে পৌঁছানোর জন্য এই জাঠাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ। তন্নু কুমারী ও তার সাথীরা ‘দুনিয়া কায়েম বা কিষাণ ভাইয়া, দুনিয়া কায়েম বা কিষাণ রে’ গানের সঙ্গে ‘কৃষক নৃত্য’ উপহার দেন।

এর পর শৈলেন্দ্র কুমার বলেন, ‘ঢাই আখর প্রেম পদযাত্রা ভগত সিং এর জন্মদিনে শুরু হয়েছে, আর মহাত্মা গান্ধীর শহিদ দিবসে শেষ হবে। দুজনই ধর্মনিরপেক্ষ ভারতের স্বপ্ন দেখতেন। যখনই হিংসা আর ঘৃণা দেশের উপর হামলা করেছে, আমরা এই দুজনকে স্মরণ করি। প্রেম আর অহিংসা মানুষকে বাহাদুর তৈরি করে। হিংসা হল ভীতুর অস্ত্র। গান্ধীজি দেশের নৈতিকতার সর্বোচ্চ মহানায়ক। বাজার ব্যবস্থা মানুষকে চালিত করে ঠিক, কিন্তু গান্ধীজি মানুষকে আশান্বিত করেন।

মঞ্চে সম্মান জানানো হয় কপিলা জি, অনিতা নিধি, কপিলেশ্বর জিকে। এর পর কৃষকের জীবন যন্ত্রণার ভিত্তিতে পুতুল নৃত্য পরিবেশিত হয়। নেপথ্যে গান হচ্ছিল ‘ভাইয়া রে ভাইয়া, হাম তো বনল হি কিষাণ, হামারা বেটা ভূখল শুতে রে রাম’। এর পর ছত্তিশগড়ের নাচা-গম্মত লোকশৈলীতে নাটক অভিনয় করেন। নিসার আলী আর দেবনারায়ণ সাহু এসেছিলেন ছত্তিশগড় থেকে। গোটা পদযাত্রায় তারা সঙ্গে ছিলেন। এই নাটকে গান্ধীজির মূল্যবোধ প্রসারের চেষ্টা করা হয়েছে। সেই সঙ্গে ছিল ভগত সিং এর বিচারধারাও এই নাটকে ছিল। তার মধ্যেই মাঝে মাঝে এসেছে কবীর, রহিমের দোঁহা এবং আদম গোণ্ডবীর গজল। জীবন জাদু রাহীর গান ‘রাহোঁ পর গুলাম হামারি ভূখ নেহি হো পায়েগি’-র সঙ্গে নাটক শেষ হয়।

সমাপ্তি অনুষ্ঠানের শেষ কর্মসূচি ছিল ‘ঢাই আখর প্রেম পড়নে আউর পড়ানে আয়ে হ্যায়/ হাম ভারত সে নফরত কা দাগ মিটানে আয়ে হ্যায়’। সবার শেষে মঙ্কেশ্বর পাণ্ডে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন। প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টা অনুষ্ঠান চলার পর জাঠার কর্মসুচি শেষ হয়। সাথীরা একে অপরকে আলিঙ্গন করে পরের যাত্রায় ফের মিলিত হওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে বিদায় গ্রহণ করেন।

এই যাত্রায় সহযোগী সংস্থা ছিল বিহারের ভারতীয় গণনাট্য সঙ্ঘ (ইপ্টা), ভারতীয় জন বিকলাঙ্গ সঙ্ঘ-মোতিহারি, বিহার মহিলা সমাজ, পাটনার দলিত অধিকার মঞ্চ, আইডিয়া মোতিহারি, জন সংস্কৃতি মঞ্চ-বিহার, জনবাদী লেখক সঙ্ঘ-বিহার, কৃষক বিকাশ সমিতি-মোতিহারি, লোক পরিষদ, জসৈলি পট্টির মহাত্মাজা গান্ধী লোমরাজ সিং পুস্তকালয়, প্রগতিশীল লেখক সঙ্ঘ-বিহার, পাটনার বিহটার সীতারাম আশ্রম এবং জনবাদী সাংস্কৃতিক মোর্চার প্রেরণা শাখা।

মহাত্মা গান্ধী জিন্দাবাদ!
ভগত সিং জিন্দাবাদ!
ভারতের সংযুক্ত সাংস্কৃতিক একতা জিন্দাবাদ!

(বিহারে ঢাই আখর প্রেম পদযাত্রার প্রতিদিনের রিপোর্ট লিখেছেন সত্যেন্দ্র কুমার এবং ফটো ও ভিডিও ধারণ করেছেন দীনেশ শর্মা ও নিসার আলী। সঙ্কলন করেছেন ঊষা আঠনে)

অনুবাদঃ চন্দ্রশেখর ভট্টাচার্য

View Photos of Bihar Jatha | View Videos of Bihar Jatha

Spread the love
%d bloggers like this: