हिन्दी | English | ಕನ್ನಡ | മലയാളം | বাংলা
নবম রাজ্য ঝাড়খণ্ডে ঢাই আখর প্রেম সর্বভারতীয় সাংস্কৃতিক পদযাত্রা ছিল পুরোপুরি আদিবাসী সংস্কৃতির মিষ্টি সুর আর তালে নৃত্যের উপহার ও পরস্পর মিলনের একটি অনন্য উদাহরণ। এতে শুধু মহিলা সাথীরাই অংশ নেননি, বরং অনেক শিশু শিল্পী এবং স্কুলের ছেলেমেয়েরা সম্পূর্ণ উতসাহের সঙ্গে নিজেদের অনুষ্ঠানে প্রস্তুতি নিয়েছেন। পদযাত্রায় অনেক প্রবীণ সাথীও উতসাহিত হয়ে গ্রামে গ্রামে ঘুরে জনতার সঙ্গে বার্তালাপ করেছেন। সময় এলে নেচেছেনও। প্রত্যেক জায়গায় সেখানকার স্থানীয় সাংস্কৃতিক আদান-প্রদান করতে হবে, এই ধারণা নিয়েই ঢাই আখর প্রেম পদযাত্রার সূত্রপাত। ফলে সাংস্কৃতিক ভাবনা বিনিময়ের সময় আনুষ্ঠানিকতার সব বাধাই নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। এই পদযাত্রায় সাথীরা নিজেদের বার্তা দিতে আর নাটক দেখাতে আসেননি। বরং তারা স্থানীয় শিশু, মহিলা ও প্রবীণদের থেকে গান, বাজনা, নৃত্য এবং পথচলার সহজ আন্দাজ শিখছিলেন, তাদের জীবনের সঙ্গে একাত্ম হচ্ছিলেন। হাস্যজ্জ্বোল মুখে সব পদযাত্রীরাই স্থানীয় মানুষদের সঙ্গে মিলেমিশে নাচ গান করছিলেন। তাদের মধ্যে পারস্পরিক প্রেম ভালবাসা সম্পর্ক আপনা থেকেই উদ্বুদ্ধ করছিল।
৭ সেপ্টেম্বর, ২০২৩, বৃহষ্পতিবার
মিথ্যা, ঘৃণা আর হিংসার বিরুদ্ধে ঢাই আখর প্রেম এর ঝাড়খণ্ড রাজ্যের পদযাত্রা জনপ্রিয় ঔপন্যাসিক বিভুতিভূষণের কর্মভূমি থেকে ৮ ডিসেম্বর শুরু হয়। এর আগের সন্ধ্যায় ‘পূর্বরঙ’ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল। ঢাই আখর প্রেম পদযাত্রা আয়োজন সমিতি দ্বারা আয়োজিত এই অনুষ্ঠান হয় ঘাটশিলার গৌরীকুঞ্জে অবস্থিত তারাদাস মঞ্চে। বৃষ্টি সত্ত্বেও ঘাটশিলার সাথীদের উৎসাহ ছিল দেখার মতো।
অনুষ্ঠানের শুরু হয় বিভুতিভূষণের মূর্তিতে মাল্যার্পন করে। মাল্যদান করেন সায়েন্স ফর সোসাইটির ঝাড়খণ্ড প্রদেশের সভাপতি ডা. আলী ইমাম খান, সাধারণ সম্পাদক ডা. ডি এন এস আনন্দ, গৌরীকুঞ্জের সভাপতি তাপস চ্যাটার্জি, জনবাদী লেখক সঙ্ঘের জামশেদপুর জেলার সভাপতি অশোক শুভদর্শী, প্রগতিশীল লেখক সঙ্ঘের শশী কুমার, ছত্তিশগড় ইপ্টার নিসার আলী এবং সর্বভারতীয় সম্পাদক শৈলেন্দ্র কুমার প্রমুখ। এই অনুষ্ঠানে আলী ইমাম খান বলেন, পৃথিবী সর্বদাই সংগ্রামের ভূমি। এই পদযাত্রার বার্তা মাটির স্তরেও যাবে। আমরা ‘আমার তোমার’ সীমারেখা মুছে দেব। এই বক্তব্য এক, দুই, চারজনের নয়, আমাদের সকলের। প্রত্যেক মানুষের সমানাধিকার এবং স্বাধীনতার কথা বলবে আমাদের পদযাত্রা।
মাল্যদানের পর মঞ্চে উপস্থিত শিল্পীদের অনুষ্ঠান শুরু হয়। ইপ্টার জন্য সলিল চৌধুরীর লেখা ‘পথে এবার নামো সাথী’ গান গেয়ে শোনান দাহিগোড়ায় অবস্থিত গৌরীকুঞ্জের আশাপাশে বসবাসকারী শিশু ও কিশোরীরা। গানে অংশ নেন সুইটি বারিক, সঞ্জনা মণ্ডল, রিয়া মণ্ডল, ববিতা প্রধান, শুভাশীষ মণ্ডল আর নৃত্যে অংশ নেন ঘাটশিলার সাথী জ্যোতি মল্লিক। এছাড়াও ‘ঢাই আখর প্রেম’ গান, সাওতালী গান এবং ছত্তিশগড়ের নাচা গম্মত শৈলীতে ‘ঢাই আখর প্রেম’ নাটক অভিনীত হয়।
এই অনুষ্ঠানে পদ্মশ্রী মধু মন্সুরী ‘গাঁও ছোড়ব নাহি’ গান পরিবেশন করে জীবনেপ্রেমের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে বলেন। জনপ্রিয় কথাশিল্পী রণেন্দ্র বলেন, বর্তমান সময়ে শুধু মানুষের সঙ্গে প্রেম নয়, গোটা প্রাণী জগত ও গাছপালার সঙ্গেও প্রেমের গভগভভতভতগভত জরুরী। তবে আমাদের জীবন সুখী সুন্দর হতে পারবে। প্রগতিশীল লেখক সঙ্ঘের সাধারণ সম্পাদক মিথিলেশ সিং ও অন্যান্য সাথীরা আয়োজকদের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেন। তারাদাস মঞ্চে আয়োজক সগমিতির পক্ষ থেকে মধু মন্সুরী হংসমুখ, ট্রাইবাল রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্দেশক কথাশিল্পী রণেন্দ্র, চারুশিল্পী ভারতী, ঝাড়খণ্ড প্রগতি লেখক সঙ্ঘের সাধারণ সম্পাদক মিথিলেশ, তথ্যচিত্র নির্মাতা বিজু টোপ্পো, ডা. আলী ইমাম খান, ডা. ডি এন এস আনন্দ, অশোক শুভদর্শীকে প্রেম ও শ্রমের প্রতীক গামছা দিয়ে সম্মান জানানো হয়।
ঢাই আখর প্রেম পদযাত্রা শুরুর আগের রাতে ইপ্টা ঘাটশিলার সভাপতি পণেশ মুর্মূর বাড়ির মহিলাদের হাতে তৈরি লিট্টি চোখা দিয়ে রাতের খাওয়ার ব্যবস্থা ছিল।
৮ ডিসেম্বর, ২০২৩, শুক্রবার
ঢাই আখর প্রেম পদযাত্রার সূত্রপাত হল ৮ ডিসেম্বর, ২০২৩। শুরুতে মউভাণ্ডারে আইসিসি মজদুর ইউনিয়নের দফতরের বাসুকি মঞ্চ থেকে ছত্তিশগড়ের সাথী নিসার আলীর অনুষ্ঠান ছিল। পালামৌ ইপ্টার গণসঙ্গীতের সুরে শুরু হয় পথচলা। কমরেড ওম প্রকাশ সিং, বীরেন্দ্র সিংহদেব, মহমুদ আলী, সুশান্ত শিট, রব প্রকাশ সিং, কমরেড বিক্রম কুমার সহ অনেক মানুষ পদযাত্রার শুরু থেকে পরবর্তী গন্তব্য পর্যন্ত সঙ্গ দেন।
যাত্রায় বিরতির প্রথম স্থান ছিল চুনুডিহ ধরমবহাল। গ্রাম প্রধান বনাও মূর্মু আর মাঝি মুকেশ মূর্মু জাঠার শিল্পীদের স্বাগত জানান। সঙ্গীত পরিবেশন করেন মধু মন্সুরী। ঘাটশিলা ইপ্টার সাথীরা গ্রামবাসীদের সঙ্গে ধামসা, তুম্বদা বাজিতে লোকনৃত্য পরিবেশন করেন। গ্রামবাসীরা পরবর্তী যাত্রাবিরতির গন্তব্য পর্যন্ত সঙ্গে চলেন। রাস্তায় ঝাড়খণ্ডে প্রগতিশীল লেখক সঙ্ঘের সভাপতি রণেন্দ্র, সাধারণ সম্পাদক মিথিলেশ সিং, পদ্মশ্রী মধু মন্সুরি, ছত্তিশগড়ের নাচা গম্মত শিল্পী নিসার আলীর নেতৃত্বে দেবনারায়ণ সাহু, জগনু, হর্ষ সেন, আলোকচিত্রী বিজু টোপ্পো এবং ডালটনগঞ্জের ইপ্টার সাথী শিল্পীরা গান গাইতে গাইতে রাস্তা হাঁটেন।
এদেনবেডা গ্রাম পেরিয়ে জাঠা দুপুর বেলা ঝাপড়িশোল গ্রামে পৌঁছায়। গ্রামের মাঝি পীতাম্বর জির নেতৃত্বে গ্রামবাসীরা পারম্পরিক প্রথায় স্বাগত জানান। মধু মন্সুরি ঝাড়খণ্ডে কোরাগান গেয়ে সবাইকে আনন্দিত করেন। সিং সিংরায়া, সুন্দর হেমব্রম, বুধন সোরেন সেন্দরা গান শোনান, আর তাঁর সঙ্গে সাঁওতালি নৃত্য পরিবেশন করেন মহিলারা। ঝাপড়িশোল গ্রামের মানুষ যাত্রার আনন্দ ও নাচ গানে উদ্বুদ্ধ হয়ে স্কুলে পৌঁছে বলেন, আমাদেরও গাইতে দিতে হবে। তাদের মধ্যে দুজন পুরুষ শিল্পী, বয়স আনুমানিক ৫০ – ৫২ বছর, অনুষ্ঠানের জন্য প্রস্তুতি নিতে থাকেন। একজন কেন্দ্রী বাজানো শুরু করেন, অপরজন শাড়ি পরে, নকল নথ ও খোপা লাগিয়ে সাজেন। আখড়ায় এসে তারা গান পরিবেশন করেন। মধু মন্সুরি নিজের ইচ্ছায় তাদের সঙ্গে কথা বলেন এবং যুব সমাজ আদিবাসী বাদ্যযন্ত্রের প্রতি অনাগ্রহী জেনে চিন্তিত হন। ঘাটশিলা ইপ্টার সাথীরা সাঁওতালি গান ‘বেরেদ মেসে হো…’ গেয়ে শোনান। নিসার আলীজ নাচা গম্মত শিল্পীদল গ্রামের স্কুলে বাচ্চাদের সামনে ‘চিড়িয়া অউর শিকারী’ গীতিনাট্য অভিনয় করেন। গ্রামের মানুষ পারম্পরিক সঙ্গীত শোনান। খুব সুন্দর গান গেয়েছেন ঊর্মিলা হাঁসদা। এই গ্রামে জাঠার লোকেদের দুপুরের খাবার ব্যবস্থা ছিল।
এর পর পদযাত্রা বনকাটি হয়ে হ্যায়দলজুড়ি পৌঁছায়। সেখানে স্থানীয়দের নিয়েই সাংস্কৃতিক নানা কর্মসূচি পেশ করা হয়। হ্যায়দলজুড়ি থেকে পদযাত্রা যায় কালাঝোড়, যেখানে রাতে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়। স্থানীয় বাসিন্দা ফুদান সোরেন বেহালা বাজিয়ে পারম্পরিক সাঁওতালি গান শোনান। নিসার আলী, দেবনারায়ণ সাহু, জগনু রাম এবং হর্ষ সেন ছত্তিশগড়ি নাকচা গম্মত শৈলীর নাটক অভিনয় করেন। রাতের খাবার পর উতক্রামিত মধ্য বিদ্যালয়ে রাত্রিবাস করেন যাত্রীরা।
প্রথম দিন পদযাত্রায় পঙ্কজ শ্রীবাস্তব, প্রেম প্রকাশ, ভোলা, সঞ্জু, শশী, অনুভব, রবি, স্নেহজ মল্লিক, জ্যোতি মল্লিক, গণেশ মূর্মু, শেখর মল্লিক, ঊর্মিলা হাঁসদা, রামচন্দ্র মাণ্ডি, ডা. দেবদূত সোরেন, শশীকুমার, অঙ্কুর, অর্পিতা, উপেন্দ্র মিশ্র, শৈলেন্দ্র কুমার, অশোক শুভদর্শী, রণেন্দ্র, মিথিলেশ, ডা. আলী ইমাম খান, গীতা, মল্লিকা, মানব (পবিত্র) অরবিন্দ অঞ্জুম এবং রাকেশ অংশ নিয়েছেন।
৯ ডিসেম্বর, ২০২৩, শনিবার
ঢাই আখর প্রেম পদযাত্রাত দ্বিতীয় দিনে যাত্রা কালাঝোর উৎক্রামিত মধ্য বিদ্যালয় থেকে সকাল ৮ টায় শুরু হয়। সকাল ৯.৩০ মিনিটে যাত্রা রাজাবাসায় পৌঁছায়, যেখানে দুলাল চন্দ্র হাঁসদা, সিধো মুর্মূ যাত্রাকে স্বাগত জানান। তাদের ঢাই আখর প্রেম গামছা দিয়ে সম্মানিত করা হয়। এখানকার রাজা ইংরেজ আমলেও লগান বা কর দেওয়ার জন্য ইংরেজদের কাছে যেতেন না, ইংরেজ কর্তারা আসতেন এবং এখানে কিছুদিন থেকে অন্য জায়গায় যেতেন। সেই থেকে এই জায়গার নাম হয়ে যায় রাজাবাসা। পদযাত্রীরা রাজাবাসার গলির মধ্যে দিয়ে গান গাইতে গাইতে রাজাবাসা আখড়ায় পৌঁছায়,যেখানে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল। শুরুতেই জামশেদপুর ইপ্টার শিশু শিল্পীরা ‘ঢাই আখর প্রেম রে সাধো’ গেয়ে শোনান। এর পর ছত্তিশগড় ইপ্টার সাথী নিসার আলীর নেতৃত্বে ঢাই আখর প্রেম নামে নাটক অভিনীত হয়। নাটকের পর পালামৌ ইপ্টার শিল্পীরা একতা, সাম্য ও শান্তির উপর গান গেয়ে শোনান।
অনুষ্ঠান চলাকালেই সিধোরাম মুর্মূ, দুলাল হাঁসদা, মঙ্গল মুর্মূকে প্রেম আর শ্রমের প্রতিক গামছা দিয়ে সম্মান জানানো হয়। সাঁওতালি গান গেয়ে শোনায় ঘাটশিলা ইপ্টা। স্থানীয় আদিবাসী মহিলা সোমবারি হেমব্রম, রায়মণি টুডু আর চম্পা মুর্মূ পরম্পরাগত গান গেয়ে শোনান। সেই গানের ম,আধ্যমে তারা তাদের মা, বাবার প্রতি অগাধ শ্রদ্ধা ও ভালবাসা ব্যক্ত করেন। গানের মাধ্যমে বলা হয়, মা বাবা আমাদের জন্ম দিয়েছেন। আজ তাদের সেবার সময় সুযোগ এসেছে আর আমরা সবাইকে ফেলে রেখে চলে এসেছি। গ্রামের মহিলারা ঢাই আখর প্রেম পদযাত্রার সঙ্গে নাচতে নাচতে পথ চলেছেন।
অনুষ্ঠানের শেষে শৈলেন্দ্র কুমার গ্রান্মবাসীদের উদ্দেশ্যে বলেন, আজ গোটা বিশ্বে হিংসার বাতাবরণ ছেয়ে আছে। ক্ষমতায় থাকা লোকেরা নিজেদের মধ্যে বিভাজন তৈরি করে তাদের ক্ষমতাকে টিকিয়ে রাখতে চায়। সমাজে আজ প্রেম ভালবাসা দরকার। আমরা ভালবাসার বার্তা দেওয়ার গান নিয়েই এসেছি। আমাদের গান প্রেমের গান, খিদের বিরুদ্ধে ভাতের গান। তিনি বলেন, ঘৃণা এমন জিনিস, যা সবার আগে নিজেকেই হত্যা করে, তারপর সে অন্যকে মারে। অনুষ্ঠানের সঞ্চালনা করেন শেখর মালিক। এই গেম বাংলাভাষীদের পাওয়া গেল। কিন্তু নিজেদের মধ্যে প্রেমের ভাষা থাকায় অন্য ভাষা কোনও সমস্যা হল না।
কয়েক ডজন সাংস্কৃতিক কর্মীর সঙ্গে ডাক্তার আলী ইমাম খান, ডি এম আনন্দ, ‘ভাবি পিঁড়ি’ পত্রিকার সম্পাদক ওম প্রকাশ সিং, রায়গড় থেকে আসা রবীন্দ্র চৌবে, আহমদ বদর, অঞ্জনা, সহেন্দ্র যাত্রায় পথ চলেছেন। দ্বিতীয় দিন যাত্রায় জামশেদপুর ইপ্টার শিশু শিল্পীদের টিম বিশেষ আকর্ষণের কেন্দ্র হয়ে গিয়েছিল। শিশুদের এই টিমে ছিল রোশনী, বর্ষা, সুজল, করণ। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের সময় রাজবাসার গ্রামবাসীদের সঙ্গে বার্তালাপে বোঝা গেল যে তারা দুটি ভাষায় কথা বলেন –সাঁওতালি আর বাংলা।
আলাপ আলোচনার পর গান বাজনার সঙ্গে জাঠা পৌঁছাল বৃন্দাবনপুরী চকে। সেখানে দুটি গান গাওয়ার পর চাকুলিয়া এআইএসএফের দুই সাথী সরকার কিস্কু এবং জ্যোতি গ্রামবাসীদের সঙ্গে বাংলায় আলাপচারিতায় মগ্ন হন। সেখানে প্রাতঃরাশ করে ছাতুর সরবত খেয়ে আগের পথে যাত্রা শুরু হয়। দুপুর একটায় যাত্রা খডিয়াডিহ পৌঁছায়। সেখানে পৌঁছে দেখা যায়, একটি মাঠে চেয়ার সাজিয়ে রাখা আছে। এই মাঠে পদযাত্রীদের স্বাগত জানায় বীণাপাণী ক্লাব। এই মাঠেই বীণাপাণী ক্লাবের পাকা বাড়ি, যা তাদের দফতর। বীণাপাণী ক্লাব এই মাঠেই ঢাই আখর প্রেম পদযাত্রীদের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল। পদযাত্রীদের স্বাগত জানান নিখিল মাহাতো আর শিবনাথ সিং। স্বাগত সঙ্গীত পরিবেশন করেন সঙ্গীত শিক্ষার্থী ভারতী, মমতা, ঝুমা, জানকী প্রমুখ। লিটিল ইপ্টা, জামশেদপুরের শিল্পীরা ‘ঢাই আখর প্রেম’ সঙ্গীত পরিবেশন করে আর ঘাটশিলার শিশু শিল্পীরা সমবেত সঙ্গীত ‘ডারা ডিরি ডা’ গেয়ে শোনায়।
নিসার আলী ও তাঁর টিমের দেবনারায়ণ সাহু, জুগনু রাম, হর্ষ সেন সম্মিলিত প্রেরণাদায়ক ‘দমাদম মস্ত কলন্দর গানের সঙ্গে নাচ পরিবেশন করেন। এর পর নিসার আলীর নির্দেশনায় নাচা গম্মত শৈলীতে ‘চালক শিকারী’ নাটক পরিবেশিত হয়। গ্রামবাসীদের নাচা-গম্মত শৈলী সম্পর্কে তথ্যাদি দেওয়া হয়। দুলাল চন্দ্র হাঁসদা এই এলাকার সম্পর্কে বলেন। বক্তব্য বলেন পারভেজ ইমাম এবং আলী ইমাম খানও। যাত্রার উদ্দেশ্য বিষয়ে আলী ইমাম খান বলেন, গোটা বিশ্ব এখন হিংসার মধ্যে দিয়ে চলেছে। হিংসার আবহে আমাদের জীবনের সমস্যাগুলিও বন্দী হয়েছে। এমন সময়ে এমন যাত্রার খুব দরকার। শেখর মালিক বাংলায় যাত্রার বিষয়ে বলেন।
কর্মসূচির শেষে পদযাত্রীরা প্রভাত খবর পত্রিকার সাংবাদিক মোহম্মদ পারভেজকে শ্রম আর প্রেমের প্রতিক গামছা দিয়ে সম্মানিত করেন। জবাবে পরভেজ বলেন, প্রেমের বার্তা গ্রামে গ্রামে নিয়ে যাওয়ার জন্য এমন উদ্যোগ জরুরি ছিল। পদযাত্রীদের যত প্রশংসাই করা হোক, তা কম হবে। এর পর মনোরঞ্জন মাহাতো বাংলায় ঝুমুর গান গেয়ে শোনান। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের পর পদযাত্রীদের পর্যাপ্ত খাবার খাইয়ে তবে আগে যাওয়ার অনুমতি দেন বীণাপাণী ক্লাবের সদস্যরা। কথায় কথায় জানা যায়, এই ক্লাবের বয়স প্রায় ১০০ বছর। শিউবনাথ সিং এই ক্লাবের জন্য পুরো সময়টাই দেন আর ছোটদের গান শেখান। শিবনাথ সিং শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের শিক্ষক ছাড়াও পেশায় কৃষক। শিবনাথের সঙ্গে লিখিল রঞ্জন মাহাতো এবং গ্রামের অন্য যুবকরা ক্লাবের দেখভাল করেন।
গাইতে গাইতে ঢাই আখর প্রেম যাত্রা স্থানীয় বাসিন্দা তাপস জির নিমন্ত্রণে খডিয়াডিহ গ্রামের বড়বিল মোহল্লায় যায়। বড়বিলের হরি মন্দিরের কাছে পদযাত্রীদের দ্বারা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করে গ্রামবাসীদের সঙ্গে আলাপচারিতা হয়। শুরুতে আহমেদ বদর বলেন, বই পড়ে কেউ এটম বোমা বানাতে পারেন, কিন্তু প্রেম করতে পারে না। প্রেমের শুরু হয় নিজের ঘর ও প্রতিবেশিদের এলাকা থেকে। প্রেম শেখার ও শেখানোর বিষয়। প্রেম বিনা জীবন অসমাপ্ত থাকে। যার হৃদয়ে প্রেম আছে, সে মানুষের সুরক্ষার কথা বলে। জ্যোতি মালিক যাত্রার উদ্দেশ্য বাংলায় বুঝিয়ে বলেন। জ্যোতি গ্রামের মহিলাদের মধ্যে গিয়ে তাদের সঙ্গে কথা বলেন, তাদের সুখ দুঃখের সমভাগী হন। গ্রামবাসীদের আগামী গন্তব্য পর্যন্ত সাথী হওয়ার আবেদন জানালে তারা খুশি মনে রাজি হন।
এর পর নিসার আলীর নেতৃত্বে আফবাহ নামের গম্মত (পথের নৃত্য নাটক) অভিনীত হয়। গম্মতের পর ঐক্য, সাম্য আর শান্তির পক্ষে সমবেত সঙ্গীত গাওয়া হয়। যাত্রীদের ধন্যবাদ জানান বিকাশ ভগত। পদযাত্রীদের পরিবেশিত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের ভূয়সী প্রশংসা করেন স্থানীয় লোকেরা। যাত্রার জন্য তারা আর্থিক সহায়তাও দেন। এর পর ঢাই আখর প্রেম পদযাত্রা গালুডিহর পথে এগোয়। সন্ধ্যা ছয়টায় গালুডিহর আঞ্চলিক ময়দানে পৌঁছে সেখানে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিবেশিত হয়। এখানে লিটিল ইপ্টা, জামশেদপুর এর বাচ্চারা ‘পড়কে হাম তো ইমিকিলাব লায়েঙ্গে’ গেয়ে অনুষ্ঠানের সূত্রপাত করে। এর পর গেয়ে শোনায় ‘ঢাই আখর প্রেম পড় লে জরা/ দোস্তি কা এহতরাম কর লে জরা” গান গেয়ে শোনান। ছত্তিশগড়ের নাচা গম্মত শৈলীর পরিবেশনাও ছিল। অনুষ্ঠান শেষে দর্শকদের থেকে আবেদন আসে, আপনারা সকালেও একবার অনুষ্ঠান করতে হবে। তাদের প্রতিশ্রুতি দিয়ে সেদিনের মতো অনুষ্ঠান শেষ হয়।
জাঠায় অর্পিতা, প্রশান্ত শ্রীবাস্তব, উপেন্দ্র, শৈলেন্দ্র, ভোলা, সঞ্জু, রবি, শশী, অনুভব, বিজু টোপ্পো, ডি এন এস আনন্দ, আহমদ বদর, অঞ্জনা, বর্ষা, সুজল, করণ, রোশনি, সয়েন্দ্র, রবীন্দ্র চৌবে, অঙ্কুর, শাদাব, হীরা মানিকপুরী, ডা. শামীম, মৃদুলা মিশ্র, অধ্যাপক বি এন প্রসাদ, প্রভাত খবরের প্রতিনিধি পারভেজ আলম, মল্লিকা, স্নেহজ, শেখর মালিক প্রমুখ অংশ নিয়েছেন। এদিন জাঠায় বরেলি থেকে এসে যোগ দেন গার্গী সিং ও অঞ্জনা। বিরাট সংখ্যায় গ্রামের মহিলারা ও শিশুরা তো ছিলই।
১০ ডিসেম্বর, ২০২৩, রবিবার
ঝাড়খণ্ড প্রদেশে ঢাই আখর প্রেম পদযাত্রার তৃতীয় দিনে জাঠা মহুলিয়া থেকে এগিয়ে গেল। সুভাষ চক, গালুডি বাজারে শিল্পীরা উপস্থিত জনতার সামনে গণসঙ্গীত গেয়ে যাত্রার উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করলেন। বরাজ কলোনিতে নাচা গম্মত শিল্পীরা লোকনৃত্য পরিবেশন করেন। জ্যোতি বাংলা ভাষায় আর প্রেম প্রকাশ হিন্দিতে যাত্রার উদ্দেশ্য বিষয়ে বলেন। বরাজ থেকে উদ্দীপনা নিয়ে গণসঙ্গীত গাইতে গাইতে দিগড়ি অতিক্রম করে রাখা মাইনসের কেদার ভবনে পৌঁছায়। কমরেড কেদার দাসের জীবন সম্পর্কে বলেন শশীকুমার। তিনি জানান, কেদার দাসের জীবনের সম্পদ বলতে ছিল দু জোড়া ধুতি আর গেঞ্জি। তাঁর মৃত্যুর পর শেষ যাত্রায় মানুষের মিছিলের দৈর্ঘ্য ছিল ১০ কিলোমিটার। তিনি বলতেন, চোখের জল যদি পড়ে, সেটা হোক প্রেমের অশ্রু। হাতাহাতি হলে হোক প্রেমিক প্রেমিকার মধ্যে, ঝগড়ার মারামারি যেন না হয়। এখানে লিটল ইপ্টার শিশু শিল্পীরা ‘পড়কে হাম তো ইনকিলাব লায়েঙ্গে’ গান গেয়ে শোনান। এখান থেকে আগে এগিয়ে জাঠা পৌঁছায় জাদুগোড়া চক। সেখানেও শিশু শিল্পীরা গণগান গেয়ে শোনান।
পরের গন্তব্য ছিল ভাটিন গ্রামে লুগু মুর্মূ রেসিডেন্সিয়াল ট্রাইবাল স্কুল, যেখানে স্কুলের শিশুরা ও স্কুলের সঙ্গে যুক্ত লোকেরা পরম্পরাগত পদ্ধতিতে সাংস্কৃতিক জাঠাকে স্বাগত জানান। অনুষ্ঠানে সঞ্চালনা করছিলেন লখাই বাস্কে। অতিথি শিল্পীদের স্বাগত জানিয়ে তিনি ডুম্বু পিঠা খাওয়ান। এই স্কুলের বিষয়ে বিশদে জানান রামো সোরেন। স্কুলের ব্যাবস্থাপক, শিক্ষক শিক্ষিকাদের সঙ্গে তিনি পরিচয় করান। দুপুরের খাবার পর ধামসা (নাগাড়া) বাজিয়ে যে পরম্পরাগত নৃত্য পরিবেশিত হয়, তাতে যাত্রী শিল্পীরাও উতসাহের সঙ্গে অংশ নেন। লুগু মুর্মূ স্কুলে ইপ্টার শিশু শিল্পীরা ‘বোল ভাই ঝাড়খণ্ড’ গান গেয়ে সান্ধ্য অনুষ্ঠানের সূত্রপাত করেন। লিটিল ইপ্টার বাচ্চারা ‘ঢাই আখর প্রেম পড় লে জরা’ গেয়ে শোনান। ইপ্টা ঘাটশিলার শিল্পীরা সাঁওতালি গান ‘আলে লে লে দিশোম’ গান পরিবেশন করেন। এর পর নাচা-গম্মত শিল্পীরা লোক নাটক অভিনয় করেন। নাটকের পর বিজু টোপ্পো-র চলচ্চিত্র প্রদর্শিত হয়।
ভাটিন গ্রামেও সাংস্কৃতিক সন্ধ্যার আয়োজন হয়েছিল। আজ যাত্রায় কিছু নতুন সাথী যুক্ত হলেন, যার মধ্যে অন্যতম হলেন কথাশিল্পী কমল, কৃপাশঙ্কর, জনমত এর সম্পাদক সুধীর সুমন, বিনয়, শশীকুমার, শায়র গৌহর আজীজ, নাসিক ইপ্টার তলহা আর সঙ্কেত, মনোরমা, সঞ্জয়, সলোমন, প্রশান্ত, শ্বেতা, শশাঙ্ক, সহেন্দ্র, গার্গী, ইনজামাম, ফরহান আর লিটল ইপ্টার আরও কিছু শিল্পী।
১১ ডিসেম্বর, ২০২৩, সোমবার
চতুর্থ দিনে ভাটিনের লুগু মুর্মূ রেসিডেন্সিয়াল ট্রাইবাল স্কুল থেকে প্রাতঃরাশের পর যাত্রা শুরু হল। স্কুলের ছাত্রদের সঙ্গে বার্তালাপ করলেন সাথী নিসার আলী। তিনি শিশুদের মেকাপ করে দেখান। বাচ্চাদের সে কী উতসাহ! যাত্রায় ভাটিনের পল্টন সোরেন, আর হাড়তোপা গ্রামের ঊর্মিলা সাথী হলেন। ভাটিনের রাস্তায় গানে গানে পুরুষানুক্রমে কীভাবে প্রেমের বার্তা ছড়িয়ে গিয়েছেন সেই কথা বলতে বলতে এগোতে থাকেন। এরই মধ্যে পল্টন সোরেন সব পদযাত্রীদের তাঁর বাড়িতে নিয়ে গেল। পদযাত্রীদের অনুরোধে ঊর্মিলা সাঁওতালি ভাষায় একটি গান শোনান, যার সঙ্গে সঙ্গত করেন পল্টন সোরেন। গানে বলা আছে, বৃষ্টিতে কৃষকের খুশি আর প্রকৃতির প্রেম মিশে আছে। প্রথম যখন বৃষ্টি আসে, তার আগে কালো মেঘ দেখে ময়ূর নেচে ওঠে। প্রথম বর্ষার সঙ্গে গোটা জীব জগতের প্রেম জড়িয়ে থাকে। পল্টন সোরেনের পরিবারের প্রতি ভালবাসা প্রদর্শন করে পদযাত্রা আগে এগোয় এবং প্রায় দেড় কিলোমিটার চলার পর নামডিহি গ্রামে পৌঁছায়।
এখানে শিল্পীদের ‘বোল রে ভাই ঝাড়খণ্ডী বোলো’ ঝাড়খণ্ডী গান পরিবেশন করে অনুষ্ঠানের শুরু হয়। অনুষ্ঠানের ধারাবাহিকতায় ছত্তিশগড়ি শৈলীতে গান গেয়ে শোনান নিসার আলীর সহশিল্পীরা। শেষে সাঁওতালি গান শোনান নামডিহর ছিতামুণি হেমব্রম। গানের মধ্যে দিয়ে তিনি বলার চেষ্টা করেন যে, যতই লেখাপড়া শিখে নাও, চাষের কাজ ছেড়ো না। এর পর যাত্রা এগোয় ঝরিয়া গ্রামের দিকে। ঝরিয়া গ্রামে গিয়ে নেচে গেয়ে প্রচারপত্র বিলি করতে করতে আগে এগিয়ে রাজদোহা গ্রাম পৌঁছায়। এই গ্রামে উতক্রামিত মধ্য বিদ্যালয় প্রাঙ্গনে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা নৃত্য পরিবেশন করেন। পদযাত্রীরা এই অনুষ্ঠানের প্রশংসা করেন। এর পর নিসার আলীর নির্দেশনায় ছত্তিশগড়ি শিল্পীরা নাচা গম্মত থিয়েটার ‘ঢাই আখর প্রেম’ অভিনয় করেন। নাসিক থেকে আসা সাথী মাত্র এক দেড় মিনিটে বাচ্চাদের তালি বাজানোর নানা পদ্ধতি শেখালে শিশুরা খুব মজা পায়।
নাটক দেখে শিশুরা ও শিক্ষকরা খুব আনন্দ পেয়েছেন। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আগে শিশুদের উপযোগী শর্ট ফিল্ম দেখানো হয়। অনুষ্ঠানের শেষে শিশুদের দেখানো সেই চলচ্চিত্র নিয়ে কথা বলেন চলচ্চিত্রকার বিজু টোপ্পো। তিনি বলেন, প্রত্যেক চলচ্চিত্রেই ভালবাসার কথা আড়ালে বলা হয়। প্রেম ছাড়া কোনও ভাল কাজ বা সৃষ্টি হতে পারে না। আপনারা চলচ্চিত্রে দেখেছেন, সব জলচর প্রাণি মিলে পৃথিবীর নির্মাণ করেছে। গোটা অনুষ্ঠানের সঞ্চালক অঙ্কুর বার্তালাপের মতো করে সঞ্চালনা করেন। চলচ্চিত্র প্রদর্শনের সময় অঙ্কুরের সহযোগিতা করেন বরেলি থেকে আসা সাথী গার্গী।
এর পর পদযাত্রীরা নাচ গানের সঙ্গে রাজদোহা গ্রাম ঘুরে ঘুরে প্রচারপত্র বিলি করে এগোতে থাকেন। বানাম বাদক সঙ্গীত নাটক আকাদেমি পুরস্কার জয়ী দুর্গা প্রসাদ মুর্মূর ঘরে পৌঁছায় জাঠা। সেখানে তাঁর সঙ্গে কথাবার্তা হয়। তিনিও সুন্দর জীবনের জন্য প্রেম আবশ্যক বলে ব্যক্তি করেন এবং একটি সাঁওতালি কবিতা দুলন্ড শোনান। নাচা শৈলীর নাটক বিশেষজ্ঞ নিসার আলীর নেতৃত্বে একটি গান শোনানো হয়। এর পর নরবা নদীর পাড়ে পিকনিকের প্রাঙ্গনে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা ছিল। খাওয়া দাওয়াও হয় নদীর তীরে। এর পর পদযাত্রা এগোয় হাড়তোপার দিকে। রাস্তায় নরবা সেতু পার হয়ে বাসন্তী চক, মুর্গাঘুটুতে গানের অনুষ্ঠান করে হাড়তোপা গ্রামে পৌঁছায়। এখানে পৌঁছানো মাত্র পদযাত্রীদের স্বাগত জানান রামচন্দ্র মার্ডি ও ঊর্মিলা হাঁসদার নেতৃত্বে গ্রামবাসীরা। যাত্রায় জুড়ে গেলেন নাসিক ইপ্টার তলহা এবং সংকেত।
১২ ডিসেম্বর, ২০২৩, মঙ্গলবার
ঢাই আখর প্রেম পদযাত্রার পঞ্চম দিনের শুরু হল হাড়তোপা গ্রাম থেকে। নাচে, গানে শহিদ পূর্বপুরুষদের স্মরণ করতে করতে যাত্রা গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এল। শিশুদের সামনে পেশ হল সাংস্কৃতিক কর্মসূচি। শুরুতে শিশুরা তাদের কোমল অধুর স্বরে স্বাগত গীতিতে স্বাগতম জানাল। এর পর তারা একটি নাটক উপহার দিল, যার মাধ্যমে তারা লেখাপড়ার প্রয়োজনীয়তার কথা বলল। স্কুল শিশুদের অনুষ্ঠানের সঞ্চালক ছিলেন ঊর্মিলা হাঁসদা ও রামচন্দ্র মার্ডি।
সেখান থেকে নাচ গানের সঙ্গে যাত্রা ফের আগে এগোল। মাঝ রাস্তায় চাইবাসার সাথীরা যাত্রায় যোগ দিলেন। এভাবে মিছিলে লোক জুড়তে থাকল আরে যাত্রীরা এগোতে থাকল। প্রায় চার ক্লোমিটার চলার পর পদযাত্রীরা ডোমজুড়ি পৌঁছায়। সেখানে পদযাত্রীদের পক্ষ থেকে চলচ্চিত্রকার তরুণ মহম্মদ মাঝি পরগণা হরিপদ মুর্মূকে শ্রম আর প্রেমের প্রতীক গামছা দিয়ে স্বাগত জানান। এর উত্তরে হরিপদ মুর্মূ সব পদযাত্রীদের অনেক শুভেচ্ছা জানিয়ে বলেন, সবথেকে বড় কথা হল, আপনারা সবাই ভালবাসা বিলিয়ে দিতে এসেছেন। এর পর ঊর্মিলা ও হরিপদ যুগ্মভাবে সাওতালি সঙ্গীত গেয়ে শোনান। এই গানে বলা হয়, পাহাড় পর্বত হুল আর পাতায় সেজেছে। নদী ঝরণা সেজেছে ঝরো ঝরো জলধারায়। আমরা ফুল আর ফলে আনন্দ পাব। দুঃখের সময়ে আমরা একে অপরের পাশে দাঁড়াব। আমরা আমাদের আগামী প্রজন্মকে ভালবাসার বার্তা দিয়ে যাব।
কর্মসূচি এগিয়ে নিয়ে যেতে পরভেসজ আলম হো ভাষায় একটি গান গেয়ে শোনান। এই গানে বিরসা মুণ্ডার জীবন আর সংগ্রামের কথা সবিস্তারে বলা ছিল। সেই সঙ্গে ছিল জল, জমি, জঙ্গলের প্রতি বিরসার আন্তরিক সমর্পনের কথা। জল, জমি, জঙ্গল আর স্বাধীনতার জন্য তিনি নিজের জীবন বিসর্জন দিয়েছিলেন। এখানে সঞ্চালনা করেন ঊর্মিলা হাঁসদা।
এখান থেকে ফের নাচে গানে মুখর পদযাত্রা প্রচারপত্র বিলি করতে করতে গোবিন্দপুর স্টেশনে পৌঁছায়। সেখানে গান্ধী শান্তি প্রতিষ্ঠানের সুখচন্দ্র ঝাঁ, কমরেড কেদার দাসের পৌত্র অশোক কুমার, লাল দাস, অম্বুজ ঠাকুর, কামত, মণিকান্ত, রাকেশ তথা প্রগতিশীল লেখক সঙ্ঘের বিনয় কুমারের সঙ্গে গোবিন্দপুরের নাগরিকরা পদযাত্রীদের স্বাগত জানান। এখানে পদযাত্রার পরবর্তী গন্তব্য পর্যন্ত যুক্ত হন হিউম্যান ওয়েলফেয়ার ট্রাস্টের মুখতার আহমদ খান। এখানেই মধ্যাহ্নভোজনের ব্যবস্থা ছিল। স্টেশনের সলগাঝুড়ি ক্রশিং-এ পদযাত্রীদের মিনিট ১৫ কি ২০ অপেক্ষা করতে হয়। সেই সময়ে তারা নাচে গানে মানুষের সঙ্গে আলাপ চালান। রাস্তায় বারিগোড়ায় অল্প সময় বিরতির সময় চাইবাসা ইপ্টা, ডাল্টনগঞ্জের সাথীরা এবং নিসার আলী নিজেদের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করেন।
সন্ধ্যায় ঢাই আখর প্রেম সাংস্কৃতিক যাত্রা জেমকো এলাকার প্রেমনগরের বরিষ্ঠ নাগরিক সমিতিতে যায়, যেখানে তাদের রাত্রিবাসের ব্যবস্থা ছিল। বরিষ্ঠ নাগরিক সমিতির উঠোনে সঞ্জয় সলোমনের সঞ্চালনায় রাতে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়। ডাল্টনগঞ্জের পঙ্কজ শ্রীবাস্তব এবং নাসিকের তলহা যাত্রার অনুভব ব্যক্ত করেন। আহমদ বদর যাত্রার উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করেন। বরিষ্ঠ নাগরিক সমিতির কমরেড রামানুজ শর্মা সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, তরুণদের দেখে তার মন প্রাণপ্রাচুর্যে ভরে গিয়েছে।
১৩ ডিসেম্বর, ২০২৩, বুধবার
১৩ তারিখ সকালে প্রেমনগরের বরিষ্ঠ নাগরিক সমিতি থেকে সাকচিতে আর ডি টাটা গোলচক্করে বিরসা স্মারক মূর্তিতে বিরসা মুণ্ডাকে শ্রদ্ধা জানিয়ে ঝাড়খণ্ডের ঢাই আখর প্রেম পদযাত্রার সমাপ্তি হয়। রাস্তায় টি আর এফ গেটে আর তারপর চা গুমটিতে লিটল ইপ্টার শিশু শিল্পীরা গান গেয়ে শোনান। রাস্তাতেও শিশুরা গান গাইতে গাইতে পথ হেঁটেছে। তারা কেবল ঢাই আখর প্রেমের গানই গাইছিল না, বরং যাত্রার সময়ে বড়রা যেসব গান গাইছিলেন, সেগুলি শিখে নিয়ে সেগুলিও গাইছিল।
ঝাড়খণ্ড সাংস্কৃতিক পদযাত্রার সংক্ষিপ্ত বিবরণ
ঝাড়খণ্ডে ২০২৩-এর ৭ থেকে ১৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত চলা এই পদযাত্রার বিরতির বিভিন্ন স্থানে স্কুল, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলি তাদের স্বাগত জানিয়েছে, থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করেছে। ৭ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় ঘাটশিলায় প্রখ্যাত সাহিত্যিক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়ি গৌরীকুঞ্জে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করে পদযাত্রা শুরু হয়েছিল। প্রথম দিন মৌ ভাণ্ডার পর্যন্ত গিয়ে পদযাত্রা রাতের বিশ্রাম নেয়। তার পর প্রথম দিন, ৮ ডিসেম্বর, চুনুডিহ, ধরমবহল, এদেলবেড়া, ঝাঁপড়িশোল, বনকাটি, হেন্দেলজুড়ি হয়ে রাতে জাঠা কালাঝোরে বিশ্রাম নেয়। দ্বিতীয় দিন গালুডিহ, তৃতীয় দিন ভাটিনে রাত্রিবাস হয়। ১১ ডিসেম্বর জাঠা আগে এগিয়ে সঙ্গীত নাটক আকাদেমি পুরস্কার জয়ী বানাম বাদক ডুঙরডিহিতে দুর্গা প্রসাদ মুর্মূর বাড়ি যায়। ১১ তারিখ রাতে হাড়তোপায় রাত্রিবাস ছিল ঊর্মিলা হাঁসদার বাড়িতে। ১২ ডিসেম্বর মুর্গাঘুট্টু হয়ে দুপুরে গোবিন্দপুরে মধ্যাহ্নভোজনের পর সন্ধ্যায় বর্মা মাইনস এলাকায় প্রেমনগরের বরিষ্ঠ নাগরিক সমিতিতে যায়। এটাই ছিল যাত্রার শেষ রাত্রিবাস। ১৩ ডিসেম্বর সকাল ৮টায় প্রেমনগর থেকে সাংস্কৃতিক পদযাত্রা যায় সাকচিতে বিরসা মুণ্ডার মূর্তির পাদদেশে, যেখানে তার আনুষ্ঠানিক সমাপ্তি ঘোষিত হয়।
যাত্রার সহযোগী সংগঠন
ঝাড়খণ্ড-এ ঢাই আখর প্রেম পদযাত্রা সফল করার জন্য ইপ্টা ছাড়াও গান্ধী শান্তি প্রতিষ্ঠান, জনবাদী লেখক সঙঘ, সাংস্কৃতিক সংগঠন গোমহেড, দ্য আম্ব্রেলা ক্রিয়েশনস, নাট্য সংস্থা ‘পথ’, কলা মন্দির, সেলুলায়েড চ্যাপ্টার, হিউমেন ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট, গৌরীকুঞ্জ উন্নয়ন সমিতি, বরিষ্ঠ নাগরিক সমিতি, মশাল মিউজ, বর্বোদয় সঙ্ঘ, ভাবী পিঁড়ি, লোক আলোক এবং নিউজটেল ছিল সহযোগী সংগঠন।
পদযাত্রী ও সহযাত্রী
গোটা কর্মসূচিতে ঝড়খণ্ড আয়োজন সমিতির অর্পিতা, শশী কুমার, উপেন্দ্র, শৈলেন্দ্র কুমার, অঙ্কুর, আহমদ বদর, অঞ্জনা, গার্গী, মনোরমা, শ্বেতা, হীরা আরকানে, সঞ্জয় সলোমন, সহেন্দ্র কুমার, প্রশান্ত, বিক্রম কুমার, নাদিরা, তাবাস্যুম, রেশমা; জনবাদী লেখক সমিতির জাতীয় সম্পাদক আলী ইমাম খান, অশোক শুভদর্শী, বরুণ প্রভাত, প্রগতিশীল লেখক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মিথিলেশ, গল্পকার কৃপাশঙ্কর, গল্পকার কমল, বিনয় কুমার, ভাবী পিঁড়ির কমরেড ওম, জন সংস্কৃতি মঞ্চের সুধীর সুমন, গোমহেড সংস্থার রামচন্দ্র মার্ডি, ঊর্মিলা হাঁসদা, বিখ্যাত ঔপন্যাসিক রণেন্দ্র, ভারতী জি, পদ্মশ্রী মধু মনসুরি, রাঁচি থেকে রাকেশ, পালামু আইপিটিএ থেকে প্রেম প্রকাশ, রবিশঙ্কর, মৃদুলা মিশ্র, সঞ্জীব, ভোলা, শশী, অনুভব, আকাশ, তালহা, মহারাষ্ট্র আইপিটিএ থেকে সংকেত, ঘাটশিলা আইপিটিএ এবং শেখর প্রমুখ। মল্লিক, জ্যোতি মল্লিক, কমরেড ওম, গণেশ মুর্মু, ডি ডি লোহরা, রবিশঙ্কর, চন্দ্রিমা, তাপস, মল্লিকা, লাতেহারের চলচ্চিত্র নির্মাতা বিজু তোপ্পো, ছত্তিশগড়ের রায়পুর থেকে নাচা-গম্মত থিয়েটারের নিসার আলি, দেবনারায়ণ সাহু, জগনু রাম, হর্ষ সেন, রায়গড়ের রবীন্দ্র চৌবে, ঊষা ভার্মা, মানব কল্যাণ ট্রাস্টের মুখতার আহমেদ খান এবং অন্য বন্ধুরা, অম্বুজ ঠাকুর, কামত, অশোক কুমার লাল দাস, রাকেশ, গোবিন্দপুর থেকে মণিকান্ত, সিনিয়র সিটিজেন কমিটি থেকে রামানুজ শর্মা, রাধেশ্যাম, লিটল আইপিটিএ থেকে বর্ষা, সুজল, মানব, গীতা, স্নেহাজ, রোশনি, করণ, দিব্যা, সুরভী, মিসল, নমরা। শ্রাবণ, গণেশ, লক্ষ্মী, চাইবাসা আইপিটিএ-র তরুণ মোহাম্মদ, কাউসার পারভেজ, খুশবু, সঞ্জয় চৌধুরী প্রমুখ। এরা ছাড়াও ঝাড়খণ্ডের সোসাইটি ফর সায়েন্স-এর সাধারণ সম্পাদক ডিএনএস আনন্দ, নাট্য সংগঠন ‘পথ’-এর মহম্মদ নিজাম, ছবি, রূপেশ, রঘু, খুরশিদ, নেহা, সুষমা, টারজান, গান্ধী পিস ফাউন্ডেশনের অরবিন্দ আঞ্জুম, পূর্ব সিংভূম জেলা সর্বোদয় মণ্ডলের সভাপতি ডাঃ সুখচন্দ্র ঝা, মিডিয়া কর্মী শশাঙ্ক শেখর, গৌতম-সহ আরও অনেকে অংশ নেন।
রিপোর্ট: অর্পিতা, শেখর মল্লিক, শশাঙ্ক শেখর
অনুবাদ: চন্দ্রশেখর ভট্টাচার্য